ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনায় পা গেলেও জীবনযুদ্ধে থেমে যাননি মোতালেব

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৫

দুর্ঘটনায় পা গেলেও জীবনযুদ্ধে থেমে যাননি মোতালেব

এমদাদুল হক তুহিন ॥ এক পা নেই তাঁর, অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে ৬নং বাসে উঠলেন। বাসে চড়ে বসা যাত্রীরা ভেবেছিলন তিনি হয়ত হাত পেতে বসবেন। সবার দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিয়ে বাসের ভাড়া তুলতে লাগলেন। ‘মামা, কই যাবেন? ভাই ভাড়াটা? মামা, গাড়ি খালি আছে। ভাড়াটা দিয়া দ্যান। আমি একলা মানুষ সবার ভাড়া তুলতে হইব।’ এমনই নানা সংলাপে বাসের ভাড়া সংগ্রহে গভীর মনোনিবেশ এক পা হারানো পঙ্গু মোতালেবের। যাত্রীরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কাজ করে খাওয়ার এই বিরল দৃষ্টান্ত দেখে। সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ বছর আগে এক পা হারিয়ে মোতালেব এখন পঙ্গু। কষ্ট উপেক্ষা করে এখন জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। পঙ্গু অনেকেই মানুষের সাহায্য গ্রহণ করে জীবন কাটিয়ে দিলেও ব্যতিক্রম তিনি। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত কারও বিন্দুমাত্র সাহায্য গ্রহণ নয়Ñ এমন প্রত্যয়েই মোতালেব এগিয়ে চলেছেন তাঁর জীবন। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা মোতালেব। বাসের হেল্পার। ৩০ বছর বয়সী মোতালেব কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা মোঃ শহীদ ও মা খোদেজা বেগম উভয়েই গ্রামে থাকেন। পিতামাতার জীবনের সায়াহ্নে তাঁদের পাশে ঠিকভাবে দাঁড়াতে না পারায় মোতালেবের খুব আক্ষেপ, ‘বয়স ৩০ হইছে, পা না হারাইলে বাবা মারে ঠেহা পাঠাইতে পারতাম’ বলেন তিনি। সহায়সম্বলহীন পঙ্গু অনেকেই সাহায্য গ্রহণ করলেও আপনি কেন সে পথে হাঁটেন নি? প্রশ্নের জবাবে মোতালেব পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘নিজের শরীরে শক্তি থাকতে কেন মানুষের সাহায্য নেব? আজ আপনার সম্মুখে বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারছি। নতুবা এখন হাত পেতে বলতে হতো, ভাই দুইডা ঠেহা দেন। একজন দিলেও একশ’ জনই দিতো না। হাত পেতে হয়ত বেশি টাকা রোজগার হইত, কিন্তু মাইনষ্যে দাম দিতো না।’ দুর্ঘটনায় পা হারানো প্রসঙ্গে পরিশ্রমী মোতালেব জনকণ্ঠকে বলেন, মহাসড়কে বড় বাসের হেল্পার ছিলাম। একদিনের বিপদে আমার পা-টা চলে গেল। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। আমার ভাইবোন সে টাকা খরচ করছিল। বাসের মালিক পক্ষ মাত্র সাত হাজার টাকা দিয়েছিল। আমার জানা মতে, তখনও কারও কাছে হাত পাতি নাই। বাসের সহকারী হিসেবে কাজ করায় সমাজের অনেকের দৃষ্টি কাড়েন মোতালেব। কেউ কেউ কৃত্রিম পা সংযোজনে সাহায্য দিতে চাইলেও, প্রচ- আত্মবিশ্বাসে প্রত্যাখ্যান করেছেন মানুষের সহানুভূতি। নিজের পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দিয়েই পা সংযোজন করাতে চান তিনি। সমাজের কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি পা সংযোজন করিয়ে দেন তাহলে আপনি তা গ্রহণ করবেন, এমন প্রশ্নে মোতালেব বলেন, ‘তাহলে এই লেখাটার কোন মানেই থাকবে না। সাহায্য গ্রহণ হয়েই গেল। আমি কারও সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়েই পা সংযোজন করাতে চাই।’ এটুকু বলেই থামলেন তিনি। পরক্ষণেই বলতে শুরু করলেন, ‘পা লাগাতে যে টাকা লাগবে তা পরিশোধ করে দেব এমন শর্তে যদি কেউ সাময়িক সময়ের জন্য সাহায্য দেন তাহলে রাজি আছি। পা সংযোজন করতে দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত লাগে। আমি বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি খরচ করতে পারব না। যদি কেউ এ শর্তে টাকা দেয় তাহলে আমি নেব কিন্তু সেই টাকা আমি পরিশোধ করব এটাই মূল শর্ত।’ ঢাকার শান্তিনগরে বসবাসকারী মোতালেবকে ৬নং বাসে কাজ দিয়েছিলেন ড্রাইভার রনি। রনি বলেন, কাজ করতে ওর অনেক কষ্ট হয়। গরিব পরিবারের সন্তান। সামর্থ্য নেই বলেই হেল্পারি করছে। পা হারানোর আগেও আমার সঙ্গে কাজ করত। পরে আমিই তাঁকে ৬নং বাসে কাজ দিই। ওর মত কষ্ট করে কাজ করতে আর কাউকে দেখিনি। ৬নং বাসের নিয়মিত যাত্রী লিয়াকত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন মোতালেবের ভাড়া সংগ্রহের দিকে। তিনি বলেন, এমন পঙ্গুলোক কাজ করছে অথচ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না। মোতালেব সমাজের জন্যে উদাহরণ। মোতালেবের কাছ থেকে আমাদের সকলের শিক্ষা নেয়া উচিত।
×