ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে বেশ কিছু বাস ছেড়েছে বৃহস্পতিবার ;###;আজ পুরোদমে দূরপাল্লার বাস চলবে

অবরোধে দূরপাল্লার বাসযাত্রীদের দুর্ভোগের দু’দিন

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধে দূরপাল্লার বাসযাত্রীদের দুর্ভোগের দু’দিন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বৃহস্পতিবার। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দেশব্যাপী টানা অবরোধের তৃতীয় দিন। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালের সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস বাস কাউন্টারের সামনে সকাল ১০টা থেকে সিমেন্টের ঠা-া বেঞ্চে স্ত্রী আর ৪ বছরের একমাত্র ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন মনিরুল ইসলাম (৩৮)। মা সন্তানকে আদর করে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। তখন দুপুর বারোটা। সামান্য আলু ভাজি আর ডিম দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটি। ঠা-া হাওয়ায় পড়া কনকনে শীতে পিতামাতা আর ছোট্ট শিশুটি অধীর আগ্রহে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কখন ছাড়বে বাস। কখন গ্রামে দাদা-দাদির কাছে যাবে। শীতের পিঠাপুলি আর হাসি তামাশায় জীবন কাটবে। এরপর দুই বছরের জন্য পিতাকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। অন্য এক দেশে। সূদূর ওমানে। তাই গ্রামের যাওয়ার আনন্দে শিশুটি মাঝে মধ্যেই পিতামাতার কাছে কখন বাস ছাড়বে তাই জানতে চাইছিল। টার্মিনালের সিমেন্টের বেঞ্চে বসেই কথা হয় মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলছেন, আমি প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি করছি। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এতদিন ঢাকাতেই ছিলাম। বিদায়ী বছর কোম্পানি কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ওমানে পোস্টিং দিয়েছে। ওমানের সালাসাই এলাকায় আমাকে থাকতে হবে। বিষয়টি একদিকে আনন্দের। আবার বিষাদেরও। কারণ আমি স্ত্রী সন্তান নিয়ে যেতে পারছি না। আমাকে অন্তত দুই বছর আদরের স্ত্রী সন্তান ছাড়াই সেখানে থাকতে হবে। আগামী সোমবার আমার ওমানের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা। তিনি বলছেন, কোম্পানি আমাকে কয়েকদিনের বেড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এ জন্য স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে যশোরের গ্রামের বাড়িতে পিতামাতার কাছে রেখে যাব। আগামী দুই বছর স্ত্রী সন্তানের সেখানেই থাকার পাকা বন্দোবস্ত করে রেখেছি। স্ত্রী-সন্তানকে নিরাপদে রাখতে গ্রামের উদ্দেশে বের হয়েছি। সকাল দশটার দিকে এসেছি। আশা ছিল হয়ত বাস যাতায়াত করবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হওয়ায় কি যে আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝাতে পারব না। বাস যত ছেড়ে যাচ্ছে বাড়ি যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দুপুর সোয়া ১২টায় একটি বাস ছেড়ে গেছে। রাস্তায় তেমন কোন সমস্যা নেই বলে বাস কাউন্টার ও পুলিশের কাছে খবর পেলাম। জেনে ভাল লাগছে। আমরা দুপুর পৌনে দুটোর বাসের টিকেট কিনেছি। টিকেটের দাম সামান্য বেশি নিয়েছে। তাতেও কোন আফসোস নেই। তার পরও যদি যেতে পারি তাতেই খুশি। তবুও তো বিদেশ যাওয়ার আগে পিতামাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অন্তত ২-৩ দিন সময় কাটাতে পারব। কখন বাড়ি পৌঁছতে পারব সেই তর যেন আর সইছে না। তাই অবরোধ জেনেও স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বের হয়েছি। যেভাবে হোক আমাকে গ্রামে পৌঁছাতেই হবে। তাই অধীর আগ্রহে বসে আছি। হাতে মাত্র তিন দিন সময় আছে। পিতামাতার সঙ্গে গ্রামে দু’-একদিন সময় কাটাব। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসবে। পিঠাপুলি খাব। সবার সঙ্গে হাসি-তামাশা করব। তারপর সব সম্পর্ক সাময়িকের জন্য হলেও চুকিয়ে চলে যেতে হবে সুদূর ওমানে। অবরোধের কারণে গত দু’দিন দূরপাল্লার বাস তেমন চলাচল না করায় আমরা গ্রামে যেতে পারিনি। আবার সঠিক সময়ে ঢাকায় ফিরে যে ওমান যেতে পারব সে নিশ্চয়তাও নেই। তা নিয়ে রীতিমত দুচিন্তায় আছি। রাস্তায় কোন বিপদও হতে পারে। অবরোধের কারণে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি দিন প্রায় মাটি হওয়ার যোগাড় হয়েছে। কে ফিরিয়ে দেবে আমার মূল্যবান সময়? আমার সোনালি দিনগুলো। কথাগুলো বলতেই চোখ থেকে টপ টপ করে মনিরুল ইসলাম আর তাঁর স্ত্রীর জল ঝরছিল। মনিরুল আর তাঁর পরিবারের আনন্দের দিনগুলো অবরোধের কারণে বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে। বৃহস্পতিবার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে বেশকিছু দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে। আজ পুরোদমে দূরপাল্লার বাস চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন বাস মালিক, চালক ও বাস কাউন্টারের ম্যানেজাররা। বিশ্ব এজতেমার মতো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম উম্মাহ জমায়েত অনুষ্ঠানেও অবরোধ প্রত্যাহার না করায় ক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ মুসলমান, বাস মালিক ও চালকসহ সংশ্লিষ্টরা। গাবতলীতে সকাল থেকেই দূরপাল্লার বাসের জন্য টার্মিনালটিতে অপেক্ষা করছিলেন যাত্রীরা। সকাল থেকে দূরপাল্লার কোন বাস ছেড়ে যায়নি। তবে মানিকগঞ্জ, সাভার, মাওয়া, দৌলতিয়া, পাটুরিয়াসহ আশপাশের এলাকায় বাস চলাচল করেছে। দুপুর বারোটার পর থেকে গাবতলী থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে শুরু করে। গাবতলী বাস টার্মিনালের সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস বাস কাউন্টারের ম্যানেজার মোহাম্মদ মুক্তার (৪২) জনকণ্ঠকে জানান, দুপুর সোয়া ১২টা থেকে অনেক কোম্পানির বাস ছেড়ে গেছে। তাদেরও একটি বাস ছেড়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় অবরোধকারীদের অবস্থান ও নাশকতার বিষয়ে যাতায়াতকারী বাসের যাত্রী ও চালকদের কাছ থেকে তথ্য জেনে নিচ্ছি। এ ছাড়া গাবতলীতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও অন্যান্য জেলার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। তারা আমাদের রাস্তার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন। যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, মাগুরা, ঝিনাইদহসহ যেসব জেলায় তাদের বাস যাতায়াত করছে, সে সব জেলায় রাস্তায় তেমন ঝামেলা নেই। রাস্তায় তেমন কোন পিকেটার নেই। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব এজতেমার মতো পবিত্র মিলনমেলা অবরোধের কারণে বিঘিœত হচ্ছে। তাদের বাস যেসব জেলায় যাতায়াত করে, সে সব জেলার এজতেমাগামী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আটকা পড়ে আছেন। তাঁরা নানা অনিশ্চয়তার কারণে আসার সাহস করছেন না। তাঁদের অনেক বাসের বুকিং বাতিল হয়েছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। যারা এজতেমায় আসতে পারছেন না তারা অবরোধকারীদের গালমন্দ করছেন। বিশেষ করে যাদের পবিত্র হজ পালনের আর্থিক বা শারীরিক সক্ষমতা নেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন দেশব্যাপী টানা অবরোধ আহ্বানকারীদের ওপর। তবে রাত আটটার পর রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা থাকে। পিকেটাররা ওই সময় রাস্তায় থাকে না। এ জন্য অবরোধ ডাক দেয়ার দিন থেকেই রাত আটটার পর থেকে নিয়মিত গাবতলী থেকে বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল করছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন সোহাগ, হানিফ, কে ট্রাভেলস, শ্যামলীসহ বিভিন্ন বাস কোম্পানির গাবতলী কাউন্টার ম্যানেজার ও চালকরা। গাবতলীর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি মোতায়েন রয়েছে তিন প্লাটুন বিজিবি (বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ)।
×