ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথৎ

অবসরপ্রাপ্তদের জীবন ও মধ্যবয়সে চাকরিচ্যুতি

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ৯ জানুয়ারি ২০১৫

অবসরপ্রাপ্তদের জীবন ও মধ্যবয়সে চাকরিচ্যুতি

গত সপ্তাহের দুটো ঘটনা। নীতি-নির্ধারকদের জানানো দরকার বলে আমি মনে করি বিধায় ঘটনা দুটো দিয়েই আজকের নিবন্ধটি শুরু করছি। প্রথম ঘটনাটি শান্তিনগর বাজারের ঘটনা। আমি ফল কেনার জন্য দোকানির সঙ্গে দর কষাকষি করছি। বনিবনা হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা দোকানির আচরণই মনঃপূত হচ্ছে না। এ কারণে ক্ষিপ্তও। কিন্তু উপায় নেই। আমি একা। দোকানদাররা দলবদ্ধ। এটা ঢাকা শহরের দোকানদারদের একটা চিত্র। ক্রেতারা অসংগঠিত, বিক্রেতারা সংগঠিতÑ দোকানদাররা হকার হলে আরও বেশি। এসব কথা মনে করে ক্ষিপ্ত থেকেই দরদাম করছি। হঠাৎ পেছন থেকে এক ভদ্রলোক ডাক দিলেন। ফিরে দেখি বয়স্ক এক ভদ্রলোক। পরিচিত, খুবই পরিচিত। কিন্তু নামটা মনে করতে পারছিলাম নাÑ এটা অনেক দিন যাবতই হচ্ছে। নাম মনে হয় একদিন-দুদিন পর। ভদ্রলোক বললেন, দাদা, কেমন আছেন। কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই প্রশ্ন ‘বাসা কোথায়’। বললাম, আমি থাকি কাছেই। ভদ্রলোকও কাছেই। তাঁর চেহারায় মলিনতা। জামা-কাপড় পুরনো। চুল উস্কো খুস্কো। হাতে বাজারের ব্যাগ। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। যদ্দুর মনে পড়ে রাজস্ব বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন। এক সময় নাদুসনুদুস চেহারার লোক ছিলেন। বাসা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, জানুয়ারি মাসটা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির রোডেই আছি। ফেব্রুয়ারিতে চলে যাব ‘বনশ্রীতে’। ফ্ল্যাট কিনেছেন? না, উত্তর পেলাম। তাহলে কেন্দ্রীয় জায়গা ছাড়বেন কেন? ভদ্রলোক বললেন, বর্তমান বাসায় ঢুকেছি ৪-৫ বছর আগে ১৮ হাজার টাকা ভাড়ায়। এখন বাড়িওয়ালা চায় ২৮ হাজার টাকা। বছর বছর ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক শহরের মাঝখানে। কিন্তু এখন আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই ‘বনশ্রীতে’ যাচ্ছেন ১৬ হাজার টাকা ভাড়ায়। তাঁর ভাষ্য- সুদ আয়ের ওপর সংসার চলে। আয় হ্রাস পেয়েছে অনেক অথচ খরচ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আর তিনি তা বহন করতে পারছেন না। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের চাকরি খুব উল্লেখ করার মতো নয়। ভোগ কমাতে কমাতে এখন শেষ সীমানায়। মাসে স্বামী-স্ত্রীর ওষুধ খরচই আট হাজার টাকা। এখন চিনির খরচ নেই, লাল চা খান। ডাল, মাছ-মাংসের খরচ কম। ইউরিক এ্যাসিডের সমস্যা। বছর বছর পোশাক বদলানোর ঝামেলা নেই। কারণ তিনি অবসরপ্রাপ্ত। তবু বাসাভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যানবাহন ব্যয়, আপ্যায়ন, ভদ্রতা রক্ষা ইত্যাদি খাতের খরচই তিনি আর বহন করতে পারছেন না। এসব শুনছিলাম আর নানা কথা ভাবছিলাম। পরে আবার যোগাযোগ হবে বলে বাসায় এলাম। বিকেলে হঠাৎ এক ফোন। সচরাচর আমার মোবাইল ফোন বাজে না। আমিও অবসরপ্রাপ্ত। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম। কারও কাজেও আসি না। রাজনীতিও করি না। এক সময় যারা ‘ক্লোজ’ ছিল তারা কে কোথায় সব খবর রাখা হয় না। নাতি-নাতনি নিয়েই আছি। মাঝে মাঝে খবর পাই বন্ধুদের। অমুক বন্ধু আর নেই। আরেক বন্ধু হাসপাতালে। এসব শুনি আর মানসিকভাবে কাহিল হই। কাজের টেলিফোন আসেনি ভাবতে ভাবতেই ফোনটি ধরি। যে ছেলেটি ফোন করেছে ও বৃহত্তর বরিশালের। ভীষণ ‘স্মার্ট’ ছেলে। সাদাসিধে গ্র্যাজুয়েট। একটা বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। একবার আমার এক প্রবাসী বন্ধুর জন্য একটা ফ্ল্যাটের দরকারে ওই কোম্পানিতে ফোন করি। সেই থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। বছরদুয়েক হবে। মাঝে মাঝে খবর দেয়। সেই খবর বন্ধুকে পাঠাই। ওই সূত্রেই এবারের ফোন। বললাম, কই, আজকাল তো ফোন কর না। যা বলা, সঙ্গে সঙ্গেই তার গলার স্বর ছোট হয়ে আসল। কী হয়েছে তোমার? ছেলেটি বলল, স্যার, দুই মাস যাবত আমার চাকরি নেই, বেকার। একটা ছোট্ট বাচ্চা আমার। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। সরকারী চাকরির বয়স নেই। ব্যাংকেও ঢুকতে পারব না। আবাসন শিল্পে চাকরি নেই। আমার কোম্পানি থেকেই আমার সঙ্গে আরও তিনজনের চাকরি গেছে। সবাই এখন রাস্তায়। ওপরের দুটো ঘটনাÑ একটি অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকরিজীবীর ঘটনা। অন্যটি একটি যুবক অথচ বেকার ছেলের ঘটনা। প্রথমজন ধীরে ধীরে শহরের প্রধান জায়গা থেকে মফস্বলের দিকে যাত্রা করেছেন। ছিলেন পুরনো ঢাকায়, অল্প ভাড়ায়, স্বল্প খরচে। পরে এসেছেন গোপীবাগে, পরে সিদ্ধেশ্বরীতে। এবার যাচ্ছেন বনশ্রীর এক কোণায়। উদ্দেশ্য খরচ কমানো, বেঁচে থাকার চেষ্টা। শহরে কোন ফ্ল্যাট কিনতে পারেননি। গ্রামে যাওয়ার যোগাড় নেই। গ্রামে তার সমবয়সীরা কেউ নেই। তরুণরা চেনে না। ছোটবেলার দেখা গ্রাম আজ আর নেই। এ কারণে গ্রামে থাকার যোগাড় নেই। অসাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের মতো নেই। নদী নেই, নালা নেই। সবই নতুন। এক নতুন গ্রাম যা ভদ্রলোকের ভাল লাগে না। দ্বিতীয়জন তরুণ। মাত্র ৫-৭ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা আবাসনে। বিয়ে-শাদি, ঘর-সংসার, বাচ্চা হঠাৎ করেই চাকরি নেই অর্থাৎ কোন আয়ই নেই। এই দুটো ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে চারদিকে হইচইয়ের মধ্যেই অনেক ঘটনা ঘটছে, যা অলিখিতই থেকে যাচ্ছে। এ সবই মধ্যবিত্ত, উঠতি মধ্যবিত্তের ঘটনা। প্রথমজনের বড় খরচ বাড়িভাড়া। জ্বালাও এখানেই। এই বাড়িভাড়া দিনের পর দিন বাড়ছে। দৃশ্যত এর ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই কারও। বাসাবাড়ির যে বুয়ারা কাজ করে তাদের সমস্যার কথা অনেকেই জানে না। দুই দিন পর পর এরা বাসা বদলায়। ড্রাইভার, পিয়ন শ্রেণীর লোকেরা ঘন ঘন বাসা বদলায়। না পেরে অনেকে স্ত্রী-পুত্রকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বুয়া শ্রেণীর মহিলারাও বাসাভাড়া নেয়, ঘরভাড়া আসে ৪-৫ হাজার টাকা। ৪-৫ বাড়িতে ঠেকা কাজ করে এ টাকা সংগ্রহ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করে তারা। ঢাকা শহরের বড় খরচ বাসাভাড়া। লোকসংখ্যা যত বেড়েছে সেই তুলনায় আবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়নি। ৬ জানুয়ারি মঙ্গলবারেই একটা স্টোরি দেখলাম খবরের কাগজে। ওই স্টোরিতে বলা হয়েছেÑ গত এক বছরে ঢাকায় বাড়িভাড়া বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ নিয়ে গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪০০ গুণ। ভাবা যায়! অন্য জিনিসের কথা বাদই দিলাম। বাড়িভাড়ার তুলনায় আজকের আয় কত গুণ বেড়েছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয় স্বাধীনতার পর থেকেই বেড়েছে। এখন বার্ষিক গড় আয় প্রায় ১২০০ ডলার। চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু প্রশ্ন আয় বৃদ্ধির নয়, প্রশ্ন ব্যয়ের। আয় বৃদ্ধির তুলনায় খরচ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। একমাত্র চালের দাম বেড়েছে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে মারাত্মকভাবে। বিশেষ করে বাড়িভাড়া এবং মধ্যবিত্তের রিক্সাভাড়া। রিক্সায় পা দিলেই এখন ২০ টাকা। ছিল ১০ টাকা। ১৫ টাকার কোন ভাড়ার স্তর নেই। ১০ টাকা থেকে এক লাফে ২০ টাকা। ঢাকার মধ্যবিত্ত তিন-চার খরচের ধাক্কায় বেসামাল। বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচ, চিকিৎসা ও লেখাপড়া। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মোটামুটি ভাল চাকরি করে বেতন পায় মাসে ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২৫ হাজার টাকা বাড়িভাড়া শান্তিনগর ইত্যাদি স্থলে। অন্যত্র গেলে বাড়িভাড়া কমে কিন্তু যাতায়াত ও শিক্ষা খরচ বাড়ে। এই যে বিষয় তা অনেকে ধরতেই পারছে না। শিক্ষা খরচ নিয়ন্ত্রণ না করত পারলে, যাতায়াত খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষের অসহায়ত্ব বাড়বে বৈকি! এর মধ্যে বাজার অর্থনীতি নতুন উপসর্গ মধ্যবয়সে চাকরি হারানো। যে ছেলেটির কথা আমার লেখায় উল্লেখ করেছি সে এমন একটা কোম্পানিতে চাকরি করত যে কোম্পানির পূর্বসূরিদের কোম্পানিতে কোনদিন চাকরি যেত না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চাকরি থাকত। মালিক চিকিৎসার খরচ দিত। বিপদে-আপদে সাহায্য করত। আজ? আজ বাজার অর্থনীতির জমানা। ব্যাংকিং খাতে প্রতিদিন লোকের চাকরি যাচ্ছে। গুণের অভাবের জন্য? না, আমি নিশ্চিত নই। নতুন নতুন প্রধান কর্মকর্তারা আসে- তারা বেতন পায় আকাশচুম্বী; কিন্তু চাকরি খাওয়া তাদের একটা অভ্যাস। এ সমস্যায় ঢাকার মধ্যবিত্ত আক্রান্ত। নতুন চাকরির সুযোগ কম অথচ চাকরিজীবীদের মধ্যবয়সে চাকরি যাচ্ছে। অবসরপ্রাপ্তদের ক্ষুদ্র আয় কমছে অথচ খরচ বাড়ছে। বাড়িভাড়া আকাশচুম্বী। চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচ অবহনযোগ্য। এসব বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত। উন্নতির পাশাপাশি এ বিষয়গুলোও ভাবার বিষয়। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×