ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতি জাগানিয়া;###;আলমগীর রেজা চৌধুরী

আনন্দময়ী কেবিন

প্রকাশিত: ০৩:১৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৫

আনন্দময়ী কেবিন

দুলাল দা, আপনার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। আশ্চর্য! ভাবতে সত্যি কষ্ট হয়। মানুষের এ রকম প্রস্থান আমাকে কষ্ট দেয়। কখনও কখনওবা বিরক্তও করে। নশ্বর এ জীবন নিয়ে ক্রমাগত স্বপ্ন দেখা সত্যি বিস্ময়কর। যত সামান্য তাঁর অবস্থান হোক তাঁকে ফলবান করে তোলা নিয়ে নিরন্তর আমাদের এই টানাপড়েনের জীবনকে নির্মাণ করি। আমরা যা নির্মাণ করে যাচ্ছি। শুধু আপনি স্মৃতি হয়ে রইলেন। হয়ত জীবনের ধর্মই এ রকম। অনন্তকাল ধাবমান। দুলাল চন্দ্র বসাক। টাঙ্গাইল জেলা শহরের মেইন রাস্তার পাশে সরু গলির মধ্যে অবস্থিত চা দোকানের মালিক। আনন্দময়ী টি-স্টল। মূলত এর আয়ুষ্কাল নব্বই বছর অতিক্রম করেছে। দুলাল বসাকের পিতা রাজেন্দ্র বসাক এর মূল মালিক। রাজেন্দ্র বসাক ৩০ বছরেরও অধিক চা দোকানদারি করে গত হয়েছেন। পুত্র দুলাল বসাক পিতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ৪০ বছর চা দোকানদারি করে গত হয়েছে ক’বছর আগে। দুলাল বসাক। আমাদের দুলাল দা। বাজিতপুর বয়নশিল্পের অসাধারণ শিল্পী। আমাদের অগ্রজদের বন্ধু দুলাল ওরফে ডি-বাবু। স্বাধীনতা উত্তরকালে মফস্বল শহরগুলোর কোন কোন রেস্তরাঁয় প্রগতিশীল মোহময় আড্ডা জমে ওঠে, তার মধ্যে টাঙ্গাইলের আনন্দময়ী উল্লেখযোগ্য। এভাবেই একদিন আনন্দময়ীকে আবিষ্কার করে ফেলি। সেই যে যাত্রা শুরু, আজও তার বিরাম নেই। আনন্দময়ী শহরের এঁদো গলির মধ্যে দো’চালা টিনের ঘর। পাশে গোপী সাহার শিল্পশ্রী টেইলারিং, আরেক পাশে আলম ড্রেস হাউস। সামনে আজাদ বুক ডিপোর সঙ্গে জলিল ভাইয়ের প্রেস। বাক্সবন্দী রবীন্দ্রনাথ। অচল একটি মাস্টার ক্লক ঝুলে আছে। কতকালের ধুলোকণার আবরণ নিয়ে অস্বচ্ছ কাঁচ রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করে দিয়েছে। সময়ের সাক্ষী নিয়ে চেয়ার-টেবিলের ভাঙ্গা পা-সমূহ তার জীর্ণতাকে প্রকাশ করছে। সবকিছু সাদামাটা বাহুল্যযুক্ত নয়। শুধু পার্থক্য একটি। তা হলো জীবনের নান্দনিক বিশ্লেষণ, জীবনকে নির্মাণ করা আর তার নির্মিত মানুষগুলো আপন বিভায় উজ্জ্বল। আনন্দময়ীর সদস্যরা বিভিন্ন পেশার মানুষ, তবুও আত্মীয়-শিল্পঋদ্ধ। খুব সহজে অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে আবিষ্কার করা পথ তৈরিতে ব্রত। মুক্তচিন্তা বহির্প্রকাশের চমৎকার সম্মিলনী। চিত্রকর শুনছেন, ওইখানটায় শিল্পাচার্য বসে বেড়ায় টাঙ্গানো গণেশের স্কেচ করেছিলেন পেন্সিল দিয়ে। ওই যে দরজার পাশে হাতল ভাঙ্গা চেয়ারটায় পা এলিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিশোর দুলালকে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বাক্সবন্দী করেছ ক্যান?’ রাজনীতিবিদ শুনছেন, মওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোণের চেয়ারটায় জাঁকিয়ে বসে হাঁক ছাড়ছেন ‘দুলাল চা দে।’ অথবা সি আর দাস, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এই কেবিনে চা পান করেছেন। শিক্ষাবিদ শুনছেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাউল তাপস মুহম্মদ মুনসুর উদ্দিন চা খেতে খেতে সুফিতত্ত্ব নিয়ে তর্কে মেতেছিলেন। নাট্যকর্মী শুনছেন, সৈয়দ নুরুল হুদা, সুবিনয় দাস, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, আলমগীর খান মেনু, গোলাম আম্বিয়া নুরী, আবদুর রহমান রক্কু নাট্যকলার সর্বশেষ কর্ম নিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে কথা বলছেন। আজকের প্রজন্মের নবীন লেখকরা শুনছেন, কবি রফিক আজাদ, আবু কায়সার, মাহবুব সাদিক, সায্যাদ কাদির, আল মুজাহিদী, বুলবুল খান মাহবুব, মীর আবুল খায়ের দিনরাত তর্কে মেতেছেন, আধুনিক কবিতার গতি প্রকৃতি নিয়ে। আর আমরা মানে, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, রতন মাহমুদ, মাহমুদ কামাল, মাহবুব হাসান, শফিকুল হাসান, হাবীব আসাদ, শফিক ইমতিয়াজ, নুরুল ইসলাম বাদল, শ্যামল সেন, আনিসুর রহমান রঞ্জু, নিহার সরকার, খন্দকার নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ শাহজাহান, রফিকুল ইসলাম রতন, রাসেদ রহমান, বিদ্যুৎ খোশনবীশ, স্বপন সৌমিত্র আরও অনেক কাব্য সহযাত্রী উল্লেখিত কবিদের কাব্যতত্ত্বেও শামিল হয়েছি। এসব মানুষের আনাগোনার নীরব সাক্ষী দুলাল চন্দ্র বসাক। আনন্দময়ী নামক এ চা দোকানের মালিক। মৃদুকণ্ঠে তাঁদের এ বর্ণনা আমাদের অতীতের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিত। আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ’৪৯-এর উপনির্বাচন, তরুণ ছাত্রনেতা শামসুল হকের বিজয়, মওলানা ভাসানীর বাগমারী সম্মেলন, ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন, ১১ দফার জাতীয় নেতৃবৃন্দ আনন্দময়ীর অগ্রজ সদস্য। এর অবশ্য একটা কারণ ছিল। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ অফিস আনন্দময়ীর অতি নিকটে। তাই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে খ্যাতিমান মানুষেরা কখনও পিতা রাজেন্দ্র বসাক, কখনও দুলাল বসাকের চায়ের খরিদ্দার হয়েছেন। স্বাধীনতাপরবর্তী আমরা যাঁরা সর্বকনিষ্ঠ সদস্যভুক্ত হলাম তারা মূলত নাট্যকর্মী, কবিতাকর্মী, বাম রাজনীতির তরুণ যোদ্ধা, আইনজীবী, যাঁরা নিজেদের আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। জীবনের বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। সফলতাটুকু অভিনেতার। আনন্দময়ী শুধু কালের কথক। কালবেলার ঘণ্টা বাজাচ্ছে। সময় অতিক্রান্ত প্রাচীন বটবিরিক্ষির। কালের পলেস্তেরায় অনেক ধুলোবালি মেখে আনন্দময়ীতে আজও আড্ডা জমছে। সকাল-সন্ধ্যায় মুক্তচিন্তার মানুষেরা চাঁদের হাট বসাচ্ছে। দুলাল বসাকের আনন্দময়ীর উত্তরসূরি সুশীল বসাক আমাদের অন্তরের সুহৃদয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রায় এক শতক ধরে যাঁরা এর সদস্য ছিলেন আমরা তাঁদের আত্মার আত্মীয় ভেবে আগামী দিনগুলো নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। প্রয়াত দুলাল বসাক। আমাদের দুলাল দা, আপনাকে চুপি চুপি বলি, সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘আড্ডা আমাকে লেখক করেছে।’ বিশ্বাস করুন, আপনার আনন্দময়ীর জন্য আজও কবিতা লিখি। লিপিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে খুঁজে চলেছি শিল্পের দরজা। এভাবে একদিন আমিও কী স্মৃতি হব! আপনার মতো! অগ্রজের মতো! [email protected]
×