ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিবিরের বোমা কেড়ে নিল অনিকের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

শিবিরের বোমা কেড়ে নিল অনিকের স্বপ্ন

গাফফার খান চৌধুরী/ওসমান হারুন মাহমুদ ॥ গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ছোড়া বোমার আঘাতে অন্ধ হওয়ার পথে ফেনী সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মেধাবী ছাত্র মিনহাজুল ইসলাম অনিক। তার ডান চোখ ও ব্রেন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোমায় একমাত্র ছেলের এমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা পরিবার। একমাত্র ছেলেকে প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বোমা বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার পথে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনিকের মা ছেলের অপরাধ কি তা জানতে চেয়েছেন বোমাবাজ আর তাদের নির্দেশদাতাদের কাছে। অনিকের পিতার নাম মিজানুর রহমান (৪৭)। ২০০৫ থেকে ওমান প্রবাসী। মা জেসমিন রহমান (৩৮) গৃহিণী। একমাত্র বোন ফাহমিদা আফ্রিন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া থানাধীন জৈলসকুর গ্রামে। সুখের সংসার। সচ্ছল পরিবার। তেমন আর্থিক টানাপোড়েন নেই। দুই সন্তানকে মানুষ করাই মায়ের একমাত্র কাজ। বিদেশে পিতার ঘাম ঝরানো টাকায় তাই করছিলেন মা। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতেই পরিবারটি ফেনী শহরের ডাক্তারপাড়া এলাকায় বসবাস করছেন। কিন্তু বিধি বাম। সে স্বপ্নে বালি পড়েছে। বোমায় তছনছ করে দিয়েছে সে স্বপ্ন। গত ৫ জানুয়ারি। বিকেল আনুমানিক পৌনে ৫টা। প্রতিদিনের মতো অনিক তার সহপাঠী একই স্কুলের ছাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী হৃদয়ের (ডাকনাম) সঙ্গে মাস্টারপাড়ার বিজয় স্যারের বাসায় গণিত বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছিল। ওইদিন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সারাদেশে সমাবেশ করার চেষ্টা করছিল। এ নিয়ে ফেনীতে ব্যাপক হাঙ্গামা হচ্ছিল। পুলিশের বাধার মুখে ফেনীর বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলা চালায় ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা। অনিক আর হৃদয় ডাক্তার গলির কাছে এলে একটি বোমা তাদের মুখে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ভিজে যায় দুই ছাত্র। ওই রাতেই আহতদের ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য পরে হৃদয়কে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আর অনিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অনিক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে ভবিষ্যতের মেধাবী প্রজন্মের অন্যতম সদস্য অনিক। ছেলের বিছানার পাশেই বিলাপ করে কাঁদছেন মা জেসমিন রহমান। অনিকের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাওয়া মাত্রই উচ্চৈস্বরে কাঁদতে থাকেন। বলেন, আমার একমাত্র বুকের ধন। তার ডান চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্রেনেও মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত। ভবিষ্যতে অনিকের অবস্থার কতটা উন্নতি হবে তা নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসকরা। তারা সুস্পষ্ট করে তেমন কিছুই বলতে পারছেন না। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। তিনদিন ধরে এক কাপড়ে হাসপাতালে আছি। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ক্ষুধা নেই। কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। মাত্র ২ মাস আগেই ছেলের এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি দেখতে বাড়ি এসেছিলেন স্বামী। সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলেকে রেখে গেলেন। আর এখন কি অবস্থা। আমি এর কি জবাব দেব। জেএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে অনিক। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। একমাত্র ছেলেকে বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা। বুয়েটে সুযোগ না পেলে বিদেশ থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পড়ানোর ইচ্ছা আছে। কিন্তু আজ সবই অনিশ্চিত। ভবিষ্যতে অনিকের কি অবস্থা হতে পারে সে সম্পর্কে চিকিৎসকরা আগাম তেমন কিছুই জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এরপরই আবার গগনবিদারী আর্তনাদ করতে থাকেন অনিকের মা। অজানা আশঙ্কায় তিনি সবার কাছে পাগলের মতো দোয়া চেয়ে বেড়াচ্ছেন। কান্নারত অনিকের মা বিলাপ করে বলছিলেন, ঘরে বসে টেলিভিশনে খবর দেখেছি। কোনদিন ভাবিনি নিজেরাই একদিন পত্র-পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশনের খবর হয়ে যাব। বোমার আঘাতে আমার স্বপ্ন উড়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছে। ছেলের চোখ আর ব্রেন চিরতরে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কি অপরাধ ছিল আমার ছেলের। আমি তার জবাব চাই বোমাবাজ আর বোমাবাজদের নির্দেশদাতাদের কাছে। বোমাবাজরা আমার সব কেড়ে নেয়ার যোগাড় করেছে। ছেলের যদি মারাত্মক কিছু হয়ে যায়, আর মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর কি হবে আমার আর আমার স্বামীর? আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? আমি বোমাবাজ আর তাদের নির্দেশদাতাদের আমার ছেলের পরিণতির মতো শাস্তি চাই। আমাদের ফেনী সংবাদদাতা জানান, বোমা হামলায় দুই স্কুলছাত্র আহত হওয়ার প্রতিবাদে ও হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঘটনার পরদিন থেকেই ফেনী সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করছে। কর্মসূচীতে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন সংগঠন, ফেনী পৌর মেয়র হাজী আলাউদ্দিন ও ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ সমাজের বিভিন্নস্তরের মানুষ। সংসদ সদস্য আহত দুইজনের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার টাকা করে একলাখ টাকা আনুদানসহ চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার বহনের ঘোষণা দিয়েছেন।
×