ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বক্তব্য বিবৃতি প্রচার প্রকাশ করা যাবে না হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা

পলাতক তারেকের

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

পলাতক তারেকের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় তার কোন বক্তব্য-বিবৃতি সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট। বুধবার একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়। আদেশে, তথ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের পাশাপাশি রুলও জারি করেছে আদালত। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। চার সপ্তাহের মধ্যে তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিটিভির মহাপরিচালক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, একুশে টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও তারেক রহমানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থানের বর্তমান অবস্থা জানাতে পররাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারেক রহমানের পাসপোর্টের মেয়াদ জানিয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য তাদের ৩০দিন সময় দেয়া হয়েছে। আবেদনকারী পক্ষে আদালতে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, এ্যাডভোকেট এসএম মুনীর, এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, এ্যাডভোকেট সানজিদা খানম প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। শ ম রেজাউল করিম বলেন, এই আদেশের ফলে পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক ও সামাজিক মাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমেও তারেকের কোন বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্য প্রচারের নিষেধাজ্ঞার আদেশ কিভাবে বাস্তবায়ন হবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালত বিবাদীদের প্রতি আদেশ দিয়েছে। তারা এই আদেশ বাস্তবায়ন করবে। নিশ্চয়ই তাদের কাছে বাস্তবায়নের কোন উপায় আছে। অন্য পলাতকদের বক্তব্য প্রকাশ-প্রচার করা যাবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিটে শুধু পলাতক তারেক রহমানের বিষয়ে বলা হয়েছে। আদেশটি তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তারেক রহমানের সব বক্তব্য এই আদেশের আওতায় আসবে বলেও জানান তিনি। রিট আবেদনটি দায়ের করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী লিনা। শুনানিতে শ ম রেজাউল বলেন, এটা সংবিধানের ৭(ক) এবং ৩৯ এর লঙ্ঘন। সর্বোচ্চ আদালত বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ও স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দিয়েছে। এরপরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমান বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন, পাকবন্ধু বলছেন। তিনি জনশান্তি বিনাশ করছেন। রিট আবেদনের সঙ্গে দৈনিক জনকণ্ঠ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত দুইটি প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়। এটা দেখে আদালত বলেছে, দৈনিক জনকণ্ঠ ও বিডিনিউজকে পক্ষভুক্ত করুন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করুন। শুনানিতে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, তারেক রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেরও লঙ্ঘন করেছেন। বিশ্বের কোথাও কেউ জাতির পিতার অবমাননা করে না। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় আমি গিয়েছি, সেখানে জাতির পিতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও ভারতের জাতির পিতা গান্ধীর বিরুদ্ধে কেউ বক্তব্য দেয় না। এ সময় আদালত জানায়, তিনি নাগরিকদের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন। রিট আবেদনে বলা হয়, ‘ফেরারি আসামি’ তারেক রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে নানা ‘অপরাধমূলক’ কথা বলছেন, যা দ-বিধি অনুসারেও অপরাধ। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছেন, যা তথ্য প্রযুক্তি আইন অনুসারে অপরাধ। রিটে আরও বলা হয়, বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি শান্তিভঙ্গ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছেন। পলাতক এই আসামির বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় পুনরাবৃত্তিতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যম পুনঃউৎপাদন না করলে এর পুনরাবৃত্তির সুযোগ থাকবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ বিভিন্ন মামলা মাথায় নিয়ে ছয় বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করা তারেক সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি সভায় বাংলাদেশের ইতিহাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। এসব বক্তব্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তারেককে। সেই সঙ্গে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে। টানা কয়েকটি সভায় বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বাংলাদেশে তারেকের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে, যাতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত। বিশ্বে এমন অনেক নজির রয়েছে কারও বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা, ঘটনাটি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই এমন নজির রয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় অনেক দেশে আইন করেও কোন এক ব্যক্তির বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। খোদ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার পিতৃভূমিখ্যাত ব্রিটেনেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৮৯ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার পার্লামেন্টে আইন পাস করেন, আইআরএর (আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গ্রে এ্যাডামসের কোন বক্তব্য কোন মাধ্যমেই প্রচার করা যাবে না। গ্রে এ্যাডামস ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং এ্যাক্টের সেকশন ২৯ অনুযায়ী ওই আইন পাস করা হয়। পরে ওই আইনটি চ্যালেঞ্জ করে ব্রিটিশ মিডিয়ার পক্ষ থেকে কয়েক সাংবাদিক হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকোর্ট তাদের ওই আবেদনটি খারিজ করে দেয়। রায়ে আদালত বলে, কোন কিছু প্রচার করার আগে অবশ্যই বিবেচ্য হবেÑওই প্রচারটা কল্যাণের জন্য, নাকি সন্ত্রাসের জন্য। যেহেতু গ্রে এ্যাডামসের বক্তব্য সন্ত্রাসের জন্য তাই তার বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আবেদনকারীরা পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন ব্রিটিশ সুপ্রীমকোর্টেও আপীল করেছিলেন। সেখানেও তাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর ফলে মার্গারেট থেচারের পাস করা আইনটিই বহাল থাকে।
×