ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

৮ জানুয়ারি বাহাত্তর এসো ফিরে বীর গৌরবে

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৮ জানুয়ারি ২০১৫

৮ জানুয়ারি বাহাত্তর এসো ফিরে বীর গৌরবে

উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আতঙ্ক, সংশয় আর দোলাচলে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার মানুষসহ বিশ্ববাসী, বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মুকুটহীন সম্রাট কখন মুক্ত হবেন পাকিস্তানী ‘জিন্দাখানা’ থেকে। ফাঁসির আদেশ দিয়ে পাক সামরিক বাহিনী হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করলেও বিশ্ববাসীর চাপে আর তা পেরে ওঠেনি। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাইশ দিন পেরিয়ে যায়, তবু তার স্থপতি, তার প্রতিষ্ঠাতা ফেরেনি। সারা বিশ্ব তাকিয়ে বাঙালীর মতোই কখন মুক্ত হবেন দীর্ঘ নয় মাস ধরে নিঃসঙ্গ কারাবন্দী বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা, ভাই, বন্ধু, পিতা, স্বজন। পুরো বাঙালী জাতির আশা ও বাসনাকে একটি বিন্দুতে মিলিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই আহ্বানে, তাঁরই ডাকে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছে। যে স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে, ত্রিশ লাখের প্রাণের আত্মাহুতিতে আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সেই দেশকে স্বাধীন করেছে। পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে হয়েছে বাধ্য। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’ আলোকিত সূর্যের মতো রেঙ্গে উঠেছে। সেই তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ছিল বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক উজ্জ্বল উদ্ধার। মুক্ত হলেন বাঙালীর স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির কা-ারি শেখ মুজিব বাঙালীসহ বিশ্ববাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাক জল্লাদ বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বত্রিশ নম্বরের বাসভবন থেকে আটক করে। ব্যাপক গুলিবর্ষণও করে। আটক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছে তখন। সারাদেশে পাকবাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে। বঙ্গবন্ধুকে গোপনে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং লায়ালপুর জেলে আটক রাখা হয়। পাক জল্লাদ বাহিনীপ্রধান ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ এনে কোর্ট মার্শালে বঙ্গবন্ধুর বিচার করার ঘোষণা দিলে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ছিলেন নেপথ্যে প্রধান সহায়ক, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে আবেদন জানান। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন, শেখ মুজিবের কোর্ট মার্শালে বিচার করা হলে তার পরিণতি হবে গুরুতর। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনও প্রতিবাদ জানায়। বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ সত্ত্বেও পটুয়া কামরুল হাসানের ‘জানোয়ার’ ইয়াহিয়া বিচার শুরু করে। বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করতেও রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর জন্য জেলখানার পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। এমনকি সামরিক ঘাতক বাহিনীও পাঠানো হয়েছিল জেলখানায়। কিন্তু জেলার সতর্ক ও সহৃদয় থাকায় সম্ভব হয়নি। তিন ডিসেম্বর আদালতের তথাকথিত কার্যক্রম শেষ হয় এবং ৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বিচারকরা মৃত্যুদ-ে দ-িত করে রায় দেয়। বঙ্গবন্ধু আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মামলার রায় আগেই সাজানো আছে। তাই আত্মসমর্পণ বা আইনজীবী নিয়োগের আগ্রহ দেখাননি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার আগেই ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সহায়ক হয়ে যৌথবাহিনী গড়ে তোলে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইয়াহিয়া তখনও অনড় বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদ- প্রদানে। বিশ্ববাসীর চাপও বাড়তে থাকে। অবশেষে খোদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ২০ ডিসেম্বর ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। সারা বিশ্বের চাপে ২১ ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ক্ষুব্ধ বাংলার মানুষসহ বিশ্ববাসী। তারা তখনও জানে না, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেয়া হবে কি না। অথবা ছেড়ে দিলে কবে তিনি ফিরে আসবেন। ভুট্টো জেল থেকে মুক্তি দিলেও গৃহবন্দী করেন বঙ্গবন্ধুকে। নানা ফন্দি কৌশল এঁটেও সুবিধা হয়নি। বঙ্গবন্ধু শোনালেন ভুট্টোকে, “আজ দীর্ঘ নয় মাস পর আমি আমার দেশে- আমার মানুষের কাছে যাব। তাদের সঙ্গে কোন কথা না বলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।” দীর্ঘ নয় মাস কারাগারে নিঃসঙ্গতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে কাবু হননি পাক জান্তার অপতৎপরতায়ও। ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ তখন বঙ্গবন্ধুর। উপায়হীন ভুট্টো ঘোষণা করতে রাজি হন ‘আপনি মুক্ত’। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে মুক্তি পান ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের স্থানীয় সময় ভোর রাত ৩টায়। আর বাংলাদেশে তখন ভোর চারটা এবং লন্ডনের সময় রাত দশটা। বঙ্গবন্ধু এবং ড. কামাল হোসেনকে পরিবারসহ বিমানে তুলে দেন স্বয়ং ভুট্টো। ৮ জানুয়ারি লন্ডন সময় ভোর ৬টা ৩৬ মিনিটে হিথরো এয়ারপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানী বিমানটি অবতরণ করে। তখন ব্রিটেনে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। বিশ্ববাসী তখনো জানে না বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর। বাংলার মানুষ উদগ্রীব। যুদ্ধজয়ের পর বেতার থেকে প্রচারিত হলো; বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রওয়ানা হয়েছেন অজানার উদ্দেশে। এতে বাংলার মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যায়। বাংলার মায়েরা সৃষ্টিকর্তার কাছে দু’হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে দীর্ঘ নয় মাসের পর তখনও প্রার্থনা করছেন। তখন বিকেল পেরুচ্ছে। শীতের সন্ধ্যা। বিবিসি থেকে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধু লন্ডনে। তিনি টেলিফোনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সর্বশেষ বেগম মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবরে সারা বাংলা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। এতদিনে যেন বিজয়ের স্বাদ পাবার সময় এসেছে। তাঁর নাম, তাঁর আহ্বানে বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা সশস্ত্র যুদ্ধ করে ফিরিয়ে এনেছে রক্তাক্ত পতাকা এবং স্বাধীন ভূখ-। বাঙালী যেন “মহা হুংকারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরে করিয়া আনিল বার।” সারা বাংলার পথে পথে আনন্দ মিছিলে নেমেছে তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরাও। মুক্তির সংগ্রাম শুরুর এক স্বপ্নাবিষ্ট মানুষেরা চাতকের মতো আকাশপানে তাকিয়েÑকখন আসবেন জাতির পিতা। বধ্যভূমি, ধ্বংসস্তূপ আর বিধ্বস্ত দেশে আবার নতুন চেতনায় গড়ে তোলার কাজে পুরো জাতিকে করবেন নিবেদিত। মুক্তির খবর শুনে কান্নার জল নেমে এসেছিল অযুত মানুষের চোখে। ফাঁসির মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি- এমন ভাবনা কেটে যাবার পর আনন্দের অশ্রুজল মায়েরা মুছে ছিলেন আঁচলে। চারদিকে জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগানে প্রকম্পিত। একটি আত্ম উদ্বোধনে বিকশিত জাতি রক্তরাখি পরে যে বিজয় অর্জন করেছে, তার মূল প্রতিপাদ্য ফিরে আসছেন বাংলায়- আনন্দ যেন বাঙালীর জীবনে তখন এসেছিল হৃদয়ের গভীর আবেগে মথিত হয়ে। লন্ডনে সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি ‘অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা’। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সারা বাংলাদেশের সেদিনের চিত্র আজকের বাস্তবতায় উপলব্ধি করা কঠিন। ॥ ২ ॥ বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের হোটেলে; কলকাতায়ও খবর পৌঁছে গেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তখন শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী শ্রীহট্টের অমিতাভ চৌধুরী, যিনি যুদ্ধকালে কলকাতায় তাঁর বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে রেখেছিলেন, ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকে নিজের পরিচয় দিয়ে। “তাঁর মুখে জয় বাংলা কথাটা শুনে আমি শিহরিত হয়েছিলাম এবং তিনি যখন ওই টেলিফোনেই বলতে শুরু করলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই,’ তখন আমি বাকরুদ্ধ।” এর সপ্তাহখানেক পর অমিতাভ চৌধুরী ঢাকায় এলে ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতকালে নিজের পরিচয় দিতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চিনেছি, আপনিইতো আমাকে ফোন করেছিলেন লন্ডনে।” বঙ্গবন্ধু মিয়াঁওয়ালি জেলে বন্দী সময়ের কথা বলেছেন তাঁকে; ‘তখন বারবার আবৃত্তি করতেন, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।” বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর বিশ্বের যে প্রান্তেই বাংলাভাষী মানুষরা ছিলেন, তাদের কাছে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে এসেছিল। ৮ জানুয়ারি একাত্তর- বাঙালীর উপলব্ধিতে জেগে উঠেছিল এই চেতনাটি যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×