ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পাচার্যের নবান্ন ও মনপুরা

তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়, রেখার পরিমিতি-আশ্চর্য সুন্দর শিল্পভাষা

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৭ জানুয়ারি ২০১৫

তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়, রেখার পরিমিতি-আশ্চর্য সুন্দর শিল্পভাষা

মোরসালিন মিজান ॥ জয়নুলে শুরু। পরিসমাপ্তি শিল্পাচার্য হিসেবে। মাঝখানে দীর্ঘ সময়। সময়টির ধ্রুপদী ব্যবহার। একটিমাত্র প্রদর্শনীতে এর খুব সামান্যই তুলে ধরা সম্ভব! তবে, হ্যাঁ, জয়নুলের বেলায় জাতীয় জাদুঘরের সাধ্য অনেক বেশি। শিল্পাচার্যের ছবির সবচেয়ে বড় সংগ্রহটি এখানে। আছে ৮০৭টি শিল্পকর্ম। এর কিছু গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় বটে। তারও বেশি সযত্নে রেখে দেয়া। বার বার দেখা এবং অদেখা সেইসব ছবি নিয়ে এখন চলছে বিশেষ প্রদর্শনী। শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এর আয়োজন করা হয়েছে। নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি প্রতিদিন ঘুরে দেখছেন শিল্পপ্রেমীরা। দেখছেন আর বিস্মিত হচ্ছেন। আরও একবার স্পষ্ট হচ্ছে, জয়নুলের এই বিস্ময় কাটবার নয় কোনদিন। গ্যালারিতে ঢুকতেই মন ভরে যায়। আশ্চর্য ক্ষমতার জয়নুল কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেন। অধিকারে নিয়ে নেন সবাইকে। সবকিছুকে। যে দিকে চোখ যায়, তাঁর দুর্লভ শিল্পকর্ম। কিছু বার বার দেখা। তারও বেশি ছবি প্রথমবারের মতো প্রদর্শনীতে। শিল্পী হিসেবে শুরু যখন, সে সময়ের কাজ আছে। আছে জীবনের শেষ সময়ে এসে আঁকা শিল্পাচার্যের রঙিন ক্যানভাস। সুনির্বাচিত ছবি নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা। এখানে এসে তাই চোখের পলক ফেলা দায়। জন্মশতবর্ষের আয়োজন। অঙ্কটি মাথায় রেখে প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে মোট একশ’ ছবি। তবে আরও অনেক ছবিকে ছাপিয়ে যায় তাঁর ‘নবান্ন’ ও ‘মনপুরা’। বলা চলে প্রদর্শনীর বিশেষ সংযোজন এই দুটো চিত্রকর্ম। জয়নুলের অমর কীর্তি ‘নবান্ন’। জল রংয়ে আঁকা স্ক্রল চিত্রকর্মের দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট! সঙ্গত কারণেই ছবিটি গ্যালারির এক পাশের পুরো দেয়াল ঢেকে দিয়ে সামনে আরও অনেক দূর চলে গেছে। এতে আলাদা আলাদা দৃশ্য। স্বতন্ত্র শিল্পকর্মের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত। আবার চমৎকারভাবে একসূত্রে গাঁথা। দীর্ঘতম ছবিতে শিল্পাচার্যের স্পেসের ব্যবহার দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রং তুলির আঁচড় যেখানে পড়েনি, সচেতনভাবে ফাঁকা রেখে দিয়েছেন যেটুকু জায়গা, সেটুকুও অনায়াসে মূল শিল্পকর্মের অংশ হয়ে উঠেছে। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার ঘরে ঘরে ফসল কেন্দ্রিক যে ব্যস্ততা, উৎসব অনুষ্ঠান আনন্দ হাসিরাশি- সবই এখানে অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পাচার্য। শুরুটা করা হয়েছে ধানকাটা দিয়ে। এখানে তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়ে আঁকা শ্রমজীবী মানুষ। পরের দৃশ্যে সেই ধান মাথায় করে কাঁধে করে বাড়ি ফেরা। ততক্ষণে প্রস্তুত উঠোন। সেখানে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে ধানের আঁটি। চলছে গাছ থেকে ধান আলাদা করার কাজ। এ কাজে কৃষকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে গবাদিপশু। ফসল ঘরে তোলার প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঢেঁকিতে শব্দ তুলে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। শ্রমজীবী নারীদের বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট। ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হলে শুরু হয় উৎসব পার্বণ। বিয়ের ধুম পড়ে। ছবিতে ঐতিহ্যবাহী পালকি। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরযাত্রা। তবে এখানেই শেষ করেন না জয়নুল। আরও গভীরে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা তাঁর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। সমৃদ্ধির ইতিহাসের পাশাপাশি তিনি বলতে ব্যথাভরা বঞ্চনাপূর্ণ জীবনের কথাও। শেষ চিত্রকর্মটি যেন বলে ওঠে- এই যে সুখ, সুন্দর বেঁচে থাকা, সুন্দর থাকে না সব সময়। নানা প্রতিকূলতার মুখে টিকতে না পেরে নিঃস্ব মানুষ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শহরমুখী হয়। এভাবে স্ক্রল চিত্রটি আর কেবল নবান্নের হয়ে থাকে না। গ-ি ছাড়িয়ে যায়। চিরায়ত বাংলার প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ জীবন ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের আদি আচার-অনুষ্ঠান, জীবনাচরণ কিছুই বাদ যায় না। এভাবে ‘নবান্ন’ বাঙালী জাতিসত্তার অমূল্য স্মারক হয়ে ওঠে। শিল্পপ্রেমী মানুষ তাই অনেক সময় নিয়ে ছবিটি দেখেন। মন্ত্রমুগ্ধ চোখে দেখে যান। ‘নবান্ন’ যেখানে শেষ হয়েছে তার ঠিক আগের দৃশ্যপট ভাবা যেতে পারে ‘মনপুরা’কে। কালজয়ী এই শিল্পকর্ম জয়নুলের উচ্চতাকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয়। দেখার চোখ, হৃদয়ের উপলব্ধি সম্পর্কে ধারণা দেয়। গ্যালারির বিপরীত দেয়ালে প্রদর্শিত ছবিটি ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে। এর সামনে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়ালে অন্য মানুষ হয়ে যেতে হয়। মনের ভেতর মুহূর্তেই কত শত পরিবর্তন ঘটে যায়! একটার পর একটা ভাবনা যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। তাড়া করে ফেরে। নিজের সঙ্গে নিজেরই চলে প্রশ্ন। উত্তর। হ্যাঁ, এ ছবি ১৯৭০ সালে আঁকা। সে বছর সাইক্লোনের আঘাতে ল-ভ- হয়ে গিয়েছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চল। সাইক্লোনের ভয়াবহতা নিজ চোখে দেখতে মনপুরা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন। না, চোখ দিয়ে দেখেননি। মগজে গেঁথে নিয়েছিলেন। আর তাই সেখান থেকে ফিরে তিনি গড়েন অনন্য সাধারণ এই শিল্পকর্ম। কাগজে কালো কালি, তুলি ও মোমে আঁকা ‘মনপুরা’ দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ নয় শুধু, ধ্রুপদী চারুকলার ইতিহাস বর্ণিত হচ্ছে। বন্যা সাইক্লোন এই বদ্বীপকে বার বার ক্ষতবিক্ষত করেছে। ল-ভ- করেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এলাকার পর এলাকা। সেই ধ্বংস আসলে কেমন, তা-ব আসলে কতটাÑ জয়নুল এ ছবিতে বলেছেন। ছবির পুরোটাজুড়ে মৃত্যু। ধ্বংস। করুণ মৃত্যু হয়েছে মানুষের। মা মরে পড়ে আছে। সেই কখন মরে পড়ে আছে। অথচ এখনও তাঁর বাঁচার সংগ্রাম স্পষ্ট। নখ আঁচড় কাটছে মাটিতে। কিছু একটা ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা সফল হয়নি। একই কারণে মা বাঁচাতে পারেননি তাঁর শিশু সন্তানকে। স্বামীও উল্টে পড়ে আছে। মিশে গেছে ভূমিতে। মানুষ গেছে। সেইসঙ্গে সম্পদ। মানুষের একেবারে গায়ের সঙ্গে গা লেগে পড়ে আছে গবাদিপশু। যেন জীবিত বন্ধুটি মৃত্যুতেও ছেড়ে যায়নি! এভাবে অসীম শূন্যতাকে ভাষা দেন জয়নুল। ছবির একেবারে শেষ প্রান্তে দেখা যায় একজন পুরুষ বসে আছেন। মাথা হাঁটুর কাছে নুয়ানো তাঁর। সব হারিয়ে নিঃস্ব এই মানুষটির সামনের অনেকটা অংশ শিল্পাচার্য ফাঁকা রেখে দিয়েছেন। এই অংশটুকু যেন পুরুষটির বুকের সব শূন্যতাকে ধারণ করেছে। পুরো ছবিটির সাদাকালো রং। এই রংও যেন গভীর শোকের ধারাভাষ্য। প্রদর্শনীতে আরও আছে শিল্পীর বিখ্যাত দুর্ভিক্ষ সিরিজের ছবি। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে এঁকেছিলেন তিনি। সেইসব স্কেচের কথা বলে বোঝানো দুষ্কর তো বটেই। রেখার পরিমিতি। তুলির সাবলীল গতি প্রদর্শনীর অন্য ছবিগুলোকেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে দাঁড় করায়। আভিজাত্য দেয়। এসব ছবির মধ্যে রয়েছে ‘নৌকা চালানো’, ‘মা ও শিশু’, ‘রমণী ও কলস’, ‘বাজারের পথে’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘তিন বেদেনী’, ‘রিকশাচালক’, ‘রমণী’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মৃত হনুমান’, ‘স্টিমার ও নদী’, ‘মওলানা ভাসানী’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রদর্শনীতে আছে লন্ডন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, মিসর, প্যালেস্টাইনসহ নানা দেশের ওপর ড্রয়িং ও জল রঙ। জয়নুলের একেবারে ক্লাসের কাজও রাখা হয়েছে। তাঁর স্কেচবুক থেকে নেয়া টাটকা নতুন পাতাও অনেকগুলো। সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দর একটি আয়োজন। বিশেষ এই প্রদর্শনী চলবে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।
×