ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুতিনের অগ্নিপরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৭ জানুয়ারি ২০১৫

পুতিনের অগ্নিপরীক্ষা

বিশ শতকের দুই পরাশক্তির একটি নিমজ্জিত হয়ে গেলে, বিশ্ব এখন এক পরাশক্তির লীলাখেলা দেখছে। কিন্তু ইতিহাসের পথ ধরে নিমজ্জিত শক্তিটি আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠছে, বুঝি তার উত্থানও ঘটতে যাচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলটা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট রাশিয়া। কিন্তু তাতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পাশ্চাত্যরা ১০ মাস আগে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছে। এর মাসুল হিসেবে তেলের দাম পড়ে গেছে এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। ঘরে ও বাইরে তথা অভ্যন্তরীণ ও বাহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রায় সমানতালে লড়াই করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি এবং ইউক্রেনে সামরিক অভিযান নিয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গে বিরোধ তীব্র হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সব সামলানোর চেষ্টা করছেন। কতটা পেরে উঠবেন- সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে কৌশলের দিক থেকে তিনি তাঁর শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর পয়েন্টের কাছাকাছি রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রদর্শনের মাধ্যমে উসকে দেয়া হয়েছে নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে। কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপে দুই দফায় ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি ওই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক খেলাকে পাল্টে দিয়েছে। যে কারণে রাশিয়া বাধ্য হয়েছে সাড়া দিতে। খেলায় হারতে রাজি নয় পুতিনের রাশিয়া। ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি ছড়িয়ে রয়েছে সারাবিশ্বে। রাশিয়াকে এক শৃঙ্খলিত ভল্লুকে পরিণত হওয়া এড়াতে হলে নিজের সার্বভৌমত্বকে সক্রিয়ভাবে রক্ষা করতে হবে বলে দেশবাসীকে সতর্ক করে পুতিন অবশ্য এটাও বলেছেন, পাশ্চাত্য রুশ ভল্লুককে খড়কুটো ভরা এক জাদুঘরের প্রাণীতে পরিণত করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছে। যদি ভল্লুক শূকর শিকার বন্ধ করে দিয়ে ফল কুড়াতে এবং মধু খেতে শুরু করে, তাহলে কেউ একে শিকলবদ্ধ করতে সব সময়ই চেষ্টা করবে। যখনই সে শিকলবদ্ধ হয়ে পড়বে, তখন তারা তার দাঁত ও নখ উপড়ে ফেলবে। পুতিনের প্রতিপক্ষ ওবামার দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার বর্তমান অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আর এটাই চাইছেন পশ্চিমারা। রাশিয়াকে একঘরে করে তার শক্তিকে খর্ব করা এবং একদা সোভিয়েত অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর অখ-তা রক্ষার নামে নিয়ন্ত্রণ করতে পুতিনের কৌশল নিয়ে চিন্তিত তারা। ওবামাকে বলতে হচ্ছে, ‘চার মাস আগে ওয়াশিংটনের প্রত্যেকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে পুতিন আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। আর কৌশল প্রয়োগ করে রাশিয়ার ক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। তবে রাশিয়ার বাইরে সম্ভবত কিছু মানুষ মনে করছেন, পুতিন যা করছেন তা যথেষ্ট যুগোপযোগী নয়।’ যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এমনটা বলে আসছে, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করার পদক্ষেপটি প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য কৌশলগত ভুল ছিল। পুতিনকে যাঁরা প্রতিনিয়ত ‘জিনিয়াস’ নেতা বলে থাকেন, তাঁদের রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে তাকানো উচিত। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য ধারণা, পুতিনের কর্মকাণ্ড সারাবিশ্ব থেকে রাশিয়াকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ক্রিমিয়া দখল শেষে পুরো ইউক্রেন ‘গ্রাস’ করতে চায় রাশিয়া। ২০১২ সালের ৭ মে তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন পুতিন। ওবামার দুনিয়াজুড়ে ছড়ি ঘোরানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান। ওবামা যেমন তাঁর প্রভাবশালী পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে বিশ্বের কৌশলগত অবস্থানগুলোয় আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট, পুতনিও তেমনি এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি থাকার কারণে রাশিয়ার যে সুবিধা রয়েছে তাতে সমতা আনতে পারে এমন কোন কৌশলগত অস্ত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে নেই। যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই। তাই ইইউ চায় তাদের অবশ্যই আত্মরক্ষামূলক অবস্থানের বাইরে যেতে হবে। রাশিয়ার প্রতি এক দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় কৌশল ছাড়া ইউক্রেন সম্পর্কে কোন দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি তারা খুঁজে পেতে পারে না। ইইউ নেতারা সতর্ক করেছেন রাশিয়াকে যে, ইউক্রেন থেকে সেনা সরাতে অস্বীকার করলে তারা সম্মিলিত শক্তি দিয়ে মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাতে যেতে প্রস্তুত। পুতিন বলেই দিয়েছেন, তিনি তাঁর সেনাবাহিনী না সরানোর সঙ্কল্প থেকে নড়বেন না। গত কয়েক বছর ধরেই পুতিন তাঁর লক্ষ্য নির্ধারণ করেন যে, রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। সে কারণেই অভ্যন্তরীণভাবে তাঁর প্রথম তৎপরতা ছিল অর্থনীতির ক্ষেত্রে। বিশেষ করে তেল ও গ্যাস শিল্পের ওপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। একই সঙ্গে দেশের রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ববাদী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যমের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিতে তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার অবস্থান জোরদারভাবে হাজির করা। ‘পুতিন ডকট্রিনে’র প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত হালনাগাদ করা ‘ফরেন পলিসি কনসেপ্ট ডকুমেন্টে’। সেখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল যে, রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের ওপরে, বিশেষ করে আঞ্চলিক ইন্ট্রিগেশনের ওপরে জোর দিচ্ছে। এ ইন্ট্রিগেশনের বিষয়কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নীতি নির্ধারকরা যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব দেয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয় যে, এটি আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের একটি চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। পশ্চিমা দেশগুলো মনে করেছিল, রাশিয়ার ওপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকলে রুশ অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। আর এতে কাজ না হলে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার পথ খোলা রয়েছে। তারা নিশ্চিত, রাশিয়া ইউক্রেনসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সহজে সরে আসবে না। তাদের ধারণার মধ্যে বাস্তবতা রয়েছে যদিও। ইইউর ধারণা, ইউক্রেন প্রশ্নে এখনও রাশিয়া দাবা খেলায় সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলছে। তদুপরি এক চাল এগিয়ে থাকার সুবিধাও লাভ করেছে। রাশিয়া ইউক্রেনে অর্জিত সাফল্যের পর রুশভাষীদের রক্ষার কথা বলে ইউক্রেনের পূর্বাংশে অগ্রসর হয় কিনা সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অন্য দেশ। যুক্তরাষ্ট্র বলেই দিয়েছে, যদি রাশিয়া তার আচরণ বদলায় তা হলে দরজা সবসময় খোলা রয়েছে। যদি মস্কো রুশ সেনাদের ইউক্রেন থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে সম্পাদিত ‘মিনস্ক চুক্তি’ সইয়ের পর শর্ত মান্য করে, তাহলে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়া হতে পারে। রুশবাদীরা পুতিনের প্রতি অবিচল আস্থাবান এখনও। সংঘাত এড়াতে মস্কো যে পদক্ষেপ নেবে, তা ইইউ মানবে এমনটা নয়। সকল ধরনের অবরোধের ফাঁদে পড়লেও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ানো নয়। মার্কিন ও ইইউর অব্যাহত অবরোধের পর রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিদ্যুত সংক্রান্ত চুক্তি সই করেছে। পুতিন বলে দিয়েছেন, ২০১৫ থেকে গ্যাসের দাম তুরস্কের জন্য ৬ শতাংশ কমিয়ে আনবে রাশিয়া। এছাড়া তিন বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাসের বাড়তি সরবরাহ পাঠানো হবে। পুতিন হুঁশিয়ারি দেন, ইউক্রেন অঞ্চলের দক্ষিণের গ্যাস লাইন পাইপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। পুতিন ডকট্রিন সামনে রেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাশিয়া যে অবস্থান নিয়েছে তা কি মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদে বহাল রাখা সম্ভব হবে? পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সংঘাত কতটা অনিবার্য হবে সেসব স্পষ্ট নয় এই মুহূর্তে। কিন্তু পশ্চিমা শক্তির বিপরীতে রুশ শক্তি বিকশিত হলে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি সামলে আসবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো পশ্চিমা রক্তচক্ষু থেকে রক্ষা পাবার পথ খুঁজে পাবে হয়ত। [email protected]
×