ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাশকতা পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় বের হতে দেয়া হয়নি খালেদাকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৬ জানুয়ারি ২০১৫

নাশকতা পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় বের হতে দেয়া হয়নি খালেদাকে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র নয়াপল্টন-মতিঝিল থেকে সচিবালয় হয়ে প্রেসক্লাব এবং সুপ্রীমকোর্ট এলাকায় ব্যাপক নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। বিএনপির শীর্ষ নেতারা গত কয়েকদিন বলে আসছিল ৫ জানুয়ারি সরকার উৎখাত করা হবে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে গাজীপুর সমাবেশ ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে বেছে নেয়। এ জন্য ৩ জানুয়ারি রাতেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের জন্য প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরে রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হয় আর ৫ জানুয়ারির আগে রবিবার থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজেই প্রেসক্লাবে বসে আন্দোলনের নেতৃত্বে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু আগেভাগে এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিএনপি ও জামায়াত সোমবারের বিক্ষোভ কর্মসূচীর মাধ্যমে ঢাকায় ব্যাপক নাশকতা চালিয়ে সরকার উচ্ছেদের চক্রান্ত করেছিল। এর সঙ্গে জেএমবি, হুজির মতো জঙ্গী সংগঠনগুলো অংশ নেয়ার তথ্য ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে বের হতে দিলেই এই পরিকল্পনা সফলের চেষ্টা করত বিএনপি-জামায়েত। অন্যদিকে গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, সরকার উৎখাতের চেয়ে বড় ভয় ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সনের নিরাপত্তা বিষয়টি। তৃতীয়পক্ষ বিএনপি নেত্রীর ওপর হামলা চালালে এর দায় পড়ত সরকারের ওপর। এতে দেশ আরও অস্থিতিশীল হতো। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন নিরাপত্তা চেয়ে থাকায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ৩ জানুয়ারি বিএনপির এই পরিকল্পনা জানার পরপরই সঙ্গে সঙ্গে বেগম জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয় এই দুই জায়গাতেই বিএনপির সমাবেশের প্রস্তুতি ছিল। সোমবার দলীয় কার্যালয় পুলিশ ঘিরে রাখলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নেয়। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় প্রেসক্লাবে যে কোন ঘটনা ঘটলে বিশ্বমিডিয়ায় সেই খবর ফলাও করে প্রচার হবে বিএনপি সেই সুযোগ নিতে চেয়েছিল। এছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের পাশেই সচিবালয়ের অবস্থান। প্রেসক্লাবের সামনে এ ধরনের গণজমায়েত করে সচিবালয় থেকে বিএনপি সমর্থক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে আন্দোলনকে ভিন্ন রং দেয়ার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। সম্প্রতি সরকারের কিছু বর্তমান এবং সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় যে কোন আন্দোলনে তাঁরা বিএনপির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। সূত্রগুলো জানায়, ৪ জানুয়ারি ঈদ-এ মিলাদুন্নবীর মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র। এ দিন সাধারণত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায় নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। ঢাকাজুড়েই মহানবীর আগমনের দিনে দোয়া মাহফিল, শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণে ধর্মপ্রাণ লাখ লাখ মানুষ। এর মধ্যে বেগম জিয়া একবার প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়লে তাঁকে বের করা সহজ হবে না। ঠিক ঢাকার মধ্যবর্তী এই এলাকায় বসেই তিনি বিশ্বমিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন। এর সঙ্গে প্রেসক্লাবের বিএনপি সমর্থক সাংবাদিক এবং পাশেই সুপ্রীমকোর্ট হওয়ায় আইনজীবীরাও ব্যাপকভাবে যোগ দেবেন সেখানে। রবিবার বিএনপি সমর্থক আইনজীবী এবং সাংবাদিকরা বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করে অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করার আরও এক দফা ঘোষণা দেন। সোমবার দিনজুড়েই বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের মধ্যে অবস্থান নেয়। বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলামের উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের ৮ম মজুরিবোর্ড বাস্তবায়নসহ অন্যান্য দাবিতে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সমাবেশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। সাধারণ সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের কর্মসূচীর ওপর বিএনপি নেতাকর্মীদের এই হামলাকে ন্যক্কারজনক বলে অবিহিত করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। গত এক বছর নির্বাচনের পর বিএনপি বড় কোন ইস্যু খুঁজে পায়নি। দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিএনপির কোন আন্দোলন কর্মসূচীতে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষকে টানতে পারেনি। নানা কারণে হরতাল ডাকলেও বিএনপির কোন নেতাকর্মী হরতাল সফল করতে পারেননি। হরতালের দিন জীবনযাত্রাও অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। সারাদেশে বিচ্ছিন্ন দুই একটা ঘটনা ঘটলেও তা সার্বিক আইনশৃঙ্খলার ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে দেশের স্বাধীনতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে কৌশলে বিএনপি রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি জাতির পিতাকে ‘রাজাকার’ বলায় ছাত্রলীগ তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। অন্যথায় বিএনপিকে গাজীপুরে সমাবেশ না করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। গাজীপুরে সমাবেশ না করতে পারায় বিএনপি পাঁচ জানুয়ারি ঘিরে সব পরিকল্পনা সাজায়। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি সমর্থকরা হাতবোমা, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, গাড়ি পোড়ানো, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অফিসে আগুন দেয়। আওয়ামী লীগ প্রতিরোধে নামলে বিএনপি নেতাকর্মীরা পিছটান দেয়। দুইপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে সাধারণ মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় রাজধানীর সর্বত্র অনির্দিষ্ট কালের জন্য সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় পক্ষ পুলিশকে প্রতিশ্রুতি দেয় তারা কোন নাশকতা করবে না। দুইপক্ষের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম পুলিশ নগরীতে সমাবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু বিকেলে বিএনপির মিছিলে ছাত্র শিবিরের সদস্যরা ঢুকে পড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। রবিবার রাতে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া বলেন, বাধা সত্ত্বেও সোমবারের কর্মসূচী তিনি প্রত্যাহার করছেন না। শেষ সময়ে হলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন দলীয় কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন বলে মনে করছিলেন নেতাকর্মীরা। গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ৫ জানয়ারিকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াত ব্যাপক নাশকতা সৃষ্টি করবে এমন ধারণা আগেই সরকারকে দেয়া হয়েছে। যেসব স্থানে নাশকতার আশঙ্কা করা হয়েছিল সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সুপারিশও করা হয়। সোমবার রাজধানীর ফকিরাপুলে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা কয়েকটি যানবাহন পুড়িয়ে দেয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়ার যতক্ষণ প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ তার কার্যালয়ে পুলিশী নিরাপত্তা দেয়া হবে। সোমবার নিজের কার্যালয়ে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তার খাতিরেই তো তাঁকে এভাবে রাখা হয়েছে। পুলিশ যদি মনে করে তিনি নিরাপদ, তাহলে তিনি বাসায় কিংবা নয়া পল্টনের কার্যালয়ে যেতে পারেন। তবে তিনি নিরাপদ কিনা সেটি পুলিশ বিবেচনা করবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অন্তরীণ অবস্থায় বক্তব্য দেয়া যায় না। কিন্তু খালেদা জিয়া যেহেতু সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন তাই তিনি অন্তরীণ হতে পারেন না।
×