ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঋণ আদায় হলেই সুফল মিলবে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৫

ঋণ আদায় হলেই সুফল মিলবে

রহিম শেখ ॥ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ঋণ পুনর্তফসিল ও খেলাপী ঋণ আদায়ের কারণে দুই বছর পর বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এ ছাড়া সরকারী ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সময়ে দেয়া ঋণ থেকেও বড় ধরনের আয় আসায় সামগ্রিকভাবে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। সরকারী-বেসরকারী ৪৩টি ব্যাংকের মুনাফা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মধ্যে ৩৪টি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত ও অবলোপন করা ঋণ আদায় হলেই এর প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে। আগামীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে মুনাফা আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য মুনাফা করেছিল ২০১১ সালে। তখন আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ও ঋণ চাহিদা বাড়ার কারণে সুদহার ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ওই বছর ব্যাংকগুলো ১৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করে। আর কর ও সঞ্চিতি পরবর্তী মুনাফা দাঁড়ায় ৯ হাজার ১২১ কোটি টাকা। তবে পরবর্তী দুই বছর মুনাফা ভাল হয়নি। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর অলস অর্থ পড়ে থাকে। শেয়ারবাজার থেকেও এ সময়ে ভাল মুনাফা না আসায় সামগ্রিক মুনাফা আশানুরূপ হয়নি। ২০১২ সালে ব্যাংকগুলো ১৯ হাজার ৭২৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করলেও নিট মুনাফা হয় মাত্র চার হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। আর ২০১৩ সালে পরিচালন মুনাফা কমে নেমে আসে ১৮ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আলোচ্য বছরের ডিসেম্বরে দেয়া বিশেষ সুবিধায় কিছু ঋণ পুনর্তফসিলের ফলে নিট মুনাফা বেড়ে হয় সাত হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ব্যাংকগুলোতে আশানুরূপ ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় তাদের কাছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি উদ্বৃত্ত ছিল। এর মধ্যে একেবারে অলস ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ঋণ পুনর্তফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট গ্রহণের শর্ত ও ঋণের মেয়াদ ঠিক করতে শিথিলতা দেখাতে বলা হয়। বিশেষ এ সুবিধার আওতায় বিভিন্ন ব্যাংক মোট ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্তফসিল করেছে। এতে করে কিছু অনিয়মিত ঋণ নিয়মিত হয়ে ব্যাংকের আয় খাত স্ফীত করেছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো আশানুরূপ ঋণ বিতরণ করতে না পারলেও বর্তমানে সরকারের কাছে তাদের এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে আসা সুদও তাদের আয় বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। এ ছাড়া শেষ সময়ে এসে আমদানি বাড়াও আয় বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ২০১৪ সালে সরকারী-বেসরকারী ৪৩টি ব্যাংকের মুনাফা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মধ্যে ৩৪টি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। বাকি ৮টি ব্যাংকের কাক্সিক্ষত মুনাফা করতে পারেনি। মুনাফা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১১৪৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ১১শ’ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৩শ’ কোটি ও বিশেষায়িত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ১৭৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের ১৭৮ কোটি টাকা আয় হলেও ২০১৪ সালে ৯৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১৭২৫ কোটি, এবি ব্যাংক ৮৯০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৮১১ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৪১০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৬২৫ কোটি, মার্কেন্টাইল ৪৫০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক ৮৩২ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ৩৮৮ কোটি, ইস্টার্ন ৬০০ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলাম ব্যাংক ২২১ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৫৭০ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৮৮৫ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৮৮৫ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ৩৮৬ কোটি, সিটি ব্যাংক ৫২০ কোটি, পূবালী ব্যাংক ৭৯০ কোটি, প্রাইম ব্যাংক ৭১০ কোটি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ২৫০ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৩০০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২৮০ কোটি, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ৬৪৫ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকের ৬৮০ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪৭৫, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৪১৫, আইএফআইসি ব্যাংক, ৪০৮ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৩৫০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৬৫ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৩৫০ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ৪৬০ কোটি, বাংলাদেশ ব্যাংক কমার্স ব্যাংক ১৪ কোটি টাকা। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে মধুমতি ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০১৪ সালে মুনাফা করেছে ৫১ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪২ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ৩৩, মিডল্যান্ড ১৭ কোটি, মেঘনা ১৬, ফারমার্স ৩, এনআরবি গ্লোবাল ৩ কোটি ও এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড ১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। জানা যায়, পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। নেট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। পরিচালনগত মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও কর (৪২ দশমিক ৫ শতাংশ) বাদ দিয়ে নেট মুনাফা হিসাব করা হয়। এর ওপরও কোন কোন ব্যাংকের সাধারণ রিজার্ভ খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই নেট মুনাফা হলেও তার সম্পূর্ণ অর্থ লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা যায় না; যার কারণে শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের হিসাব কষতে অপেক্ষা করতে হয় ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) আগে পরিচালনা পর্ষদের সভা পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত ছিল। তবে আগের বছরের অস্থিরতার কারণে অনেক ব্যাংক ভাল মুনাফা করতে পারেনি। এখন ঋণ আদায় কার্যক্রম ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরই নির্ভর করছে আগামী ব্যাংকগুলো কতটা মুনাফা করতে পারবে।
×