ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ৬ জানুয়ারি ২০১৫

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

(২য় পর্ব) বাংলাদেশের সমতল ভূমি থেকে নদীভাঙ্গা, বাস্তুহারা বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা ’৮০-এর দশকে ’৭৭-৭৮ থেকে তদানীন্তন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনায় একদল প্রান্তিক মানুষকে একটি বিপরীত প্রকৃতির অঞ্চলে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় প্রেরণ, ওখানে বাসঘরের জন্য জমি, জীবিকার জন্য জমি বরাদ্দ করার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন রাষ্ট্র ও সরকার এমন একটি অস্বাভাবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল? গভীর গবেষণায় না গিয়েও সাদাচোখে দেখে এ পরিকল্পনার দুটি উদ্দেশ্য বোঝা যায়, যা পরবর্তীকালে সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে, হচ্ছে। উদ্দেশ্য দুটি হচ্ছে- (১) স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে তুলনামূলকভাবে বাঙালীর পাশে দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমিতে বাঙালী বসতি প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালী পাহাড়ীর মধ্যে বিরোধ তৈরি করে একটি দীর্ঘমেয়াদী অশান্তি, সংঘর্ষ সৃষ্টির বীজ বপন করে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির শান্তি, যা উন্নয়নের প্রথম শর্ত সেটি বিনষ্ট করার দীর্ঘস্থায়ী একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল; (২) একই সঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীদের ধীরে ধীরে বাঙালীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে বাধ্য করা ও ক্রমশ বাঙালীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে পাহাড়ীদের সংখ্যালঘু করা। দীর্ঘকাল যাবত আমার মনে পাহাড়ের এই বাঙালী-পাহাড়ী অশান্তিকে কেন্দ্র করে কিছু প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে- যেমন (১) কেন তারা সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা পার্বত্য অঞ্চলে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ফেলে চলে গেল। পাহাড়ীরা যখন এক পর্যায়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল, দীর্ঘকাল সে সংগ্রাম পাহাড়ে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তখনও কেন বাঙালী বসতি স্থাপনকারীরা নিজ নিজ জেলায় পূর্ব পুরুষের গ্রামে নতুন নতুন চর, ভূমিতে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করল না? বাঙালীদের মধ্যে কখনও কেউ সমতলে পূর্বপুরুষের বসতিতে ফিরে আসার আকাক্সক্ষা বোধ করেনি, তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মানুষের একটি প্রধান প্রবণতা হচ্ছে, সে নিজে নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম না হলে সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জান-প্রাণের নিরাপত্তাকে সর্বাগ্রগণ্য মনে করে সে লক্ষ্যেই কাজ করে। মনে হয়, প্রথম পর্বে যারা ’৮০-এর দশকে প্রথম বাঙালী ‘সেটলার’ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিল, তাদের একটি বড় অংশ সমতলের চট্টগ্রাম শহরে সরে গিয়েছিল। বর্তমানে যারা রাঙ্গামাটিতে বাঙালী বসতি স্থাপনকারী হিসেবে রয়েছে, দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরের বাঙালী প্রায় নেই, সাতকানিয়ার বাঙালীও সংখ্যায় কম, বেশি বাঙালী এসেছে খুলনা, বরিশাল, মাগুরা, রাজশাহী, রংপুর, যশোর ইত্যাদি নানা জেলা থেকে। পার্বত্য অঞ্চলে ‘বাঙালী বসতি’ প্রতিষ্ঠার কাজটি জিয়া এবং এরশাদ-এ দু’জনের আমলেই শুরু হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। এরশাদের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ক্যাম্প, সেনানিবাস স্থাপন করে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালীদের বসতি বিস্তারে সহায়তা করা হয়। ক্রমে পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর এক ধরনের সেনাশাসন প্রবর্তিত হয় সেটি বাঙালী সেনা, বিডিআর, পুলিশ প্রশাসন সহযোগে এমন একটি প্রশাসনের জন্ম দেয়, যা খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালীর প্রতি পক্ষপাতের সমালোচনার মুখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই পাহাড়ীদের স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণœ হয়, আবারও তারা বসতি, জীবিকার জমি হারাতে থাকে এবং এই তিন পার্বত্য অঞ্চলে তিনটি শহর দ্রুত গড়ে ওঠে- যার দোকানপাট, হাট বাজার, খাবার রেস্তোরাঁ, থাকার হোটেল অর্থাৎ ব্যবসা বাণিজ্যের মালিকানা হয় বাঙালীর, অধিকাংশই সেনাবাহিনীর। মনে রাখতে হবে, মানুষের রক্ত একবার খেয়ে বাঘ যেমন মানুষখেকো হয়ে ওঠে, তেমনি ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের লোভে মানুষ, সে সাধারণ হোক বা সেনা-পুলিশ হোক, হয়ে ওঠে জবর-দখলকারী, কখনও কখনও তার স্বার্থে আঘাতকারীর ধর্ষক ও হত্যাকারী। এটি প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ, অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ইতোমধ্যে, ’৭৭-৭৮ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমতলের বাঙালীদের পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপনের প্রায় দীর্ঘ ৩৭ বছর সময় অতিবাহিত হয়েছে। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য কতগুলো বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করিÑ (১) বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ তার ছোট আয়তনের মধ্যেও অতি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সেজন্যই সুন্দর। এতে বদ্বীপের অসংখ্যা নদীর যেমন অবস্থান, তেমনি রয়েছে পাহাড় ঘেরা পার্বত্য অঞ্চল, আবার রয়েছে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং সুন্দরবন। বাঙালী, পাহাড়ী উভয়কে এই অতুলনীয় বৈচিত্র্যে ভরা পাহাড়, সমভূমি, নদী ও সমুদ্র ও সুন্দরবন, এর পশু-পাখি, জলচর, উভচর, স্থলবাসী, বৃক্ষবাসী সব প্রাণী ও বৃক্ষরাজিকে রক্ষা করতে এদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে এদের সঙ্গে মানিয়ে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করতে হবে- এর কিন্তু কোন বিকল্প নেই। (২) বাঙালীদের স্মরণ রাখতে হবে, জিয়া সরকার তাদের বিভুঁই, অচেনা পার্বত্য অঞ্চলে এনেছে, তাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজেদের ইচ্ছায় এ দুর্গম (তখন ছিল) অরণ্যসমৃদ্ধ ভিন্নভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতির পাহাড়ী মানুষদের মধ্যে বাস করার কথা কল্পনাও করেনি! কিন্তু যারা পাহাড়ে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা এ অঞ্চলের সঙ্গে হয়ত একরকম খাপখাইয়ে বেড়ে উঠেছে। সুতরাং পার্বত্য অঞ্চলে আজ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাহাড়ীদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অশুভ রাষ্ট্রনীতির শিকার বাঙালীদের বক্তব্য ও শুনতে হবে এবং তাদের পক্ষ থেকে সমাধানও চাইতে হবে। জানতে হবে পাহাড়ের বাসিন্দা পাহাড়ী ও বাঙালী, উভয়ের মতামত এবং উভয়ের মতে, শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য উপায়গুলো। (৩) ’৯৬ সালে সরকারের সঙ্গে পাহাড়ীদের একটি শান্তিচুক্তি হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে জটিল কিন্তু সমাধানে পৌঁছা অসম্ভব নয়Ñ ভূমি জরিপ ও বণ্টন। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে বর্তমানে সমতলে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে যত খুন, সংঘর্ষ হয়, তা অন্য যে কোন কারণে অপরাধ সংঘটনের হারের চাইতে অনেক বেশি! এর কারণ সহজবোধ্য, এ দেশে জমি কম, মানুষ বেশি! বাঙালীরা যারা ’৮০-এর দশকে এসেছে, তারা বসতঘর তৈরির জন্য ২৫ শতাংশ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য ৫ একর জমি পরিবার প্রতি লাভ করেছিল যার মালিকানার কাগজপত্র সরকার তাদের দিয়েছিল। এ জমির মধ্যে পাহাড়ও অন্তর্ভুক্ত! বর্তমানে এমন পাহাড়ে বাঙালীরা আনারস ও সেগুন গাছের চাষ করছে, যা দাদন নিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে করা হচ্ছে। এ সব বাগানের অনেক পাহাড়ী শ্রমিক হিসেবে কাজও করে। পাহাড়ীরা জুম চাষ কিছু কিছু জায়গায় করলেও তারাও কলা, কাঁঠাল, ধান, ইত্যাদির চাষও করছে। রাঙামাটি শহরে কেউ কেউ পার্লারও চালাচ্ছে, বুটিক, তাদের নিজস্ব তাঁতের বোনা কাপড় তৈরি, বিক্রি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ পরিবর্তন স্বাভাবিক ও অবধারিত। কেননা, চাকমা, মারমাসহ সব পাহাড়ী জাতির নতুন প্রজন্ম আধুনিক শিক্ষাগ্রহণ করছে, ফলে তাদের কাজকর্ম, জীবিকার ধরন বদলে যাবে। একটা কথা শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীদের মনে রাখতে হবেÑ পাহাড়ীদের আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলব, আবার তাদের ‘পাহাড়ী’ ‘আদিবাসী’ হিসেবেও দেখতে চাইবÑ তা হয় না, হবে না। বাঙালীরাও বদলাচ্ছে, পাহাড়ীরাও বদলাচ্ছে। এতে কোন সমস্যাও নেই। (৪) পাহাড়ে সমস্যা কোথায়? প্রথমত, বাঙালীদের অতিরিক্ত জনসংখ্যা পাহাড়ের নীরব নির্জনতাকে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দ্বিতীয়ত, বাঙালী মুসলমান আমরা প্রকৃতি উপাসক নই, সেজন্য আমরা মক্কা-মদীনার মরুভূমির জন্য, খেজুরের জন্য, উটের জন্য কেঁদে বুক ভাসাই। কিন্তু আমার বাড়ির পাশের নদী, খাল, পুকুরে বাড়ির সব ময়লা আবর্জনা ফেলতে মুহূর্ত দ্বিধা করি না! পাশের বাড়ির কলাগাছ কী আম-বড়ই গাছের ডাল আমার বাড়ির চাল, বেড়া ছুঁলে তখনই কাটারি হাতে ওই বাড়ন্ত ডালগুলো কেটে ফেলি! পাহাড়ে কোন বাঙালী গান গায়, বাঁশি বাজায়, ঢোল-তবলা বাজায় কি? পাহাড়, নদী, হিন্দু পাহাড়ী চাকমা-মারমাদের সবার দেবতা হতে পারে, উপাস্য হতে পারে, বৃক্ষ, শষ্য, আমপাতা, বেলপাতা, সুপারি, পশু-পাখি, পূজার উপকরণ হতে পারে এবং সেজন্য তারা উপাস্য ও উপাসনার উপকরণকেও সুরক্ষিত রাখার জন্য পূজায়, আচার-আচরণে, দৈনন্দিন জীবনে, উৎসবে তাদের কাছে বার বার নতজানু হয় ও থাকে! মক্কায় তো মরুভূমি, প্রকৃতিকে দেখেনি আরব, আগে বৃষ্টি ছিল না, এখন বৃষ্টি হয়, সেজন্য চাষাবাদ কিছু হচ্ছে। প্রকৃতি বলতে ছিল প্রখর সূর্য, লু হাওয়া, তপ্ত বালু, রাতের আকাশে নক্ষত্র-চাঁদ। আমরা দীর্ঘ সময় শেষে আরব দেশ থেকে নিজ দেশের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে একটু একটু করে নিজ দেশের প্রকৃতির সন্তান হতে চেষ্টা করছি মাত্র। তবে প্রকৃতির সেবাকারী সন্তান না হতে পারলে প্রকৃতিই তো আমাদের ধ্বংস করে। বাঙালীর আগ্রাসী চরিত্র সমস্যা সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, পাহাড়ে বার বার বাঙালী-পাহাড়ীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, সংঘর্ষে উভয় দলের কম-বেশি ভূমিকা থাকে। দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী, উদ্যোগী সংস্থার ব্যক্তিবর্গ প্রত্যেক ঘটনার পর পর যাচ্ছেন পাহাড়ীদের দেখতে। পাহাড়ীদের ক্ষয়ক্ষতি দেখে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা তাদের বক্তব্য, দাবি শুনে এবং বাঙালীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোন আলোচনা না করে, তাদের বক্তব্য না শুনে তারা ঢাকায় ফিরে আসেন ও সংবাদ সম্মেলনে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এর ফলে, দীর্ঘদিন যাবত শান্তি স্থাপনে আগ্রহীদের পাহাড়ের বাঙালীরা পক্ষপাতদুষ্ট বলে গণ্য করতে শুরু করে। বর্তমানে এ বিষয়টি সুশীল সমাজের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে! সুশীল সমাজ যখন শুধু পাহাড়ীদেরই দেখতে আসে, তাদের কথাই শোনে, আমাদের কোন কথাই শোনেন না, তাহলে তাদের আমরা এখানে আসতেই দেব নাÑ এমনই একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ৩৫-৩৬ বছর পর বাঙালীরা পাহাড়ে একটি বাস্তবতা, তাদের এড়িয়ে কেউ কোনক্রমে পাহাড়ীদের শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবে না। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×