ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল সংবিধান লঙ্ঘন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ জানুয়ারি ২০১৫

আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল সংবিধান লঙ্ঘন

আরাফাত মুন্না ॥ হরতাল। সাধারণ অর্থে, সরকারের কোন সিদ্ধান্ত বা কর্মকা-ের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের নীতি হিসেবে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বর্তমানে হরতাল শুধু সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই নয়, দেয়া হচ্ছে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও। যা সম্পূর্ণ আদালত ও সংবিধান অবমাননা। এছাড়া সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচীর যে সহিংস হরতাল পালন করছে তা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা এবং আইনজ্ঞদের মতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, সরকারী কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। তবে প্রতিবাদের নামে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণের মতো সহিংস কর্মকা- পরিচালনা করে অন্য নাগরিকের চলাফেরা-কাজকর্মে বাধা দেয়ার অধিকার কারও নেই। সংবিধান তা সমর্থন করে না। অন্যদিকে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই হরতাল দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলাম। আবার ওই রায়ের বিরুদ্ধেই তারা সর্বোচ্চ আদালতে আপীলও করছেন। এ বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, আদালতে যখন মামলাটি আসে, তখন দুটি পক্ষই থাকে (বাদী পক্ষ ও বিবাদী পক্ষ)। রায় যে কোন এক পক্ষেই যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিচারিক আদালতে কোন রায় যদি কারও বিরুদ্ধে যায়, তিনি উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় হলে হাইকোর্টে এবং হাইকোর্টের কোন রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে হবে সুপ্রীমকোর্টে। সুপ্রীমকোর্টের রায় চূড়ান্ত থাকবে। তা দুই পক্ষকেই মেনে নিতে হবে। আইনজ্ঞরা আরও বলছেন, বর্তমানে জামায়াত ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছে, যা আদালত অবমাননার শামিল। আবার তারা সুপ্রীমকোর্টে আপীলও করছেন। বিষয়টি কোনভাবেই হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই। এই কর্মকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সকলেই আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এদের শাস্তির ব্যবস্থা না করা হলে অনেকেই আদালতের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে উৎসাহিত হবে বলেও মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা। এদিকে, জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচীর হরতাল সংবিধান সমর্থন করে না। বাংলাদেশে প্রচলিত হরতাল বেশিরভাগ সময়ে সহিংসতায় রূপ নেয়, যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে চরম হুমকি। হরতালের এসব নেতিবাচক দিক সংবিধানে প্রদত্ত ৩৬, ৪০, ৪২ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন বলে মত দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবীরা। বাংলাদেশে প্রচলিত ধারার হরতালগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দলীয় স্বার্থে ডাকা হরতাল পালনে জনগণকে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘হরতাল সমর্থকগোষ্ঠী’ তাদের পক্ষে সংবিধানের ৩৭ (সমাবেশের স্বাধীনতা), ৩৮ (সংগঠনের স্বাধীনতা), ৩৯ (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদের দোহাই দেন। কিন্তু তারা ভুলে যান ওই অনুচ্ছেদগুলোতে প্রদত্ত অধিকার নিরঙ্কুশ নয়। যেমন ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের সমাবেশের স্বাধীনতা থাকবে। একইভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে প্রয়োগযোগ্য। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংগঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদিÑ (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্র ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো। সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হরতাল সমর্থনকারীরা সংবিধানের এ তিনটি অনুচ্ছেদের দোহাই দিলেও বর্তমানে প্রচলিত জ্বালাও পোড়াও ধারার হরতাল সংবিধান সমর্থন করে না। বরং জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচীর হরতালের কারণে সংবিধানের ৩৬ (চলাফেরার স্বাধীনতা), ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, ও ৪২ (সম্পত্তির অধিকার) অনুচ্ছেদ সরাসরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। হরতালের কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে না। দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়েছে স্থবির। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে ‘প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন মানা কর্তব্য’ বলা হয়েছে। কিন্তু হরতালকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াত এদেশের স্বাধীনতাকেই বিশ্বাস করে না। এ কারণেই তারা দেশের সংসদে পাস করা আইনের দ্বারা গঠিত একটি আদালতের (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ট্রাইব্যুনালের সম্মান ক্ষুণœ করছে। তিনি বলেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল অবশ্যই আদালত অবমাননার শামিল। জামায়াতের এসব কর্মকা-েই আইন করে জামায়াত নিষিদ্ধ করার যৌক্তিকতা পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী। হরতালে আতঙ্ক সৃষ্টি করার বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, হরতালে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম রাষ্ট্রদ্রোহিতা, জনগণকে ভয়ভীতি দেখানো, বাসে আগুন দেয়া, সাধারণ জনতার জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসাধন, ভাংচুর, লুটতরাজ ইত্যাদি বাংলাদেশের সংবিধান আদৌ সমর্থন করে না এবং তা দ-বিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির জনকণ্ঠকে বলেন, আদালতের আদেশ সকলের মানতে হবে। কেউ না মানলে তা আদালত অবমাননার অপরাধ হবে। জামায়াতও এখানে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিয়ে আদালত অবমাননার অপরাধ করেছে। এজন্য অবশ্যই তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, একটি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত যে হরতাল পালন করে তা, দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান এবং প্রচলিত অন্যান্য আইনের চূড়ান্ত অবমাননা। এছাড়া বিষয়টি আদালতেরও অবমাননা। তিনি বলেন, এই কর্মকা-ে যারা জড়িত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক সকলেই আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি যোগ্য অপরাধ করেছেন। তিনি বলেন, এ বিষয়টিকে কোনভাবেই হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই। এই কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে আরও অনেকেই আদালতের আদেশ ও আইন অমান্য করতে উৎসাহিত হবে। রেজাউল আরও বলেন, এর ফলে আইনের শাসন, বিচার ব্যবস্থা ও প্রচলিত রীতি-নীতি চূড়ান্ত ভাবে ভেঙে পরবে। যা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দুর্বৃত্তায়ন ও পেশি শক্তির উদ্ভব ঘটাবে। আদালত অবমাননার রুল ইস্যুর পরেও হরতাল পালন জামায়াতের চরম ঔদ্ধত্যপনাই প্রমাণ করে বলেও মন্তব্য করেন এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
×