ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঋণ পুনঃতফসিলকরণ নীতি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২ জানুয়ারি ২০১৫

ঋণ পুনঃতফসিলকরণ নীতি

সরকারের বছর শেষ জুনে, আর ব্যাংকগুলোর বছর শেষ ডিসেম্বরে। ব্যতিক্রম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের; তাদের বছর শেষ আবার জুনে। আর্থিক বছর নিয়ে কেন এই ভিন্ন ভিন্ন হিসাব তার কারণ আমি জানি না। সংশ্লিষ্ট অনেককেই জিজ্ঞেস করি, কারণ কী- তারাও জানেন না। আমরা জানি আর না জানি ডিসেম্বরকে ধরে দেশের বড় একটি আর্থিক খাতের চূড়ান্ত হিসাব হয়ে গেল গত বুধবার। ৩১ ডিসেম্বর। পৃথিবীজুড়ে বছর শেষের অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঢাকাও বাদ নেই। ব্যাংকও বাদ নেই। ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক ‘হলি ডে’। ব্যাংকগুলো তাদের বছরের হিসাব শেষ করেছে, ওই দিন গ্রাহকদের সঙ্গে কোন লেনদেন হয়নি। অনেক ব্যাংক, অবশ্যই ছোট ছোট ব্যাংক, তাদের আর্থিক অবস্থার কথা জেনে যাবে বুধবার রাতেই। বড় বড় ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা হবে না। তাদের সময় লাগবে। তবে দুই-চার দিনের মধ্যে তারাও জানতে পারবে বছর শেষে কত আমানত হলো, কত ঋণ দেয়া হলো। জানা যাবে গ্যারান্টি, ঋণপত্র, রেমিটেন্স ইত্যাদির তথ্য। কত মুনাফা হলো তা জানা যাবে। জানা যাবে ‘শ্রেণী বিন্যাসিত’ (ক্লাসিফাইড) ঋণের পরিমাণের কথা। যথারীতি ‘মিডিয়া’ আগামী এক-দুই সপ্তাহব্যাপী দেশবাসীকে খবর দেবে ব্যাংকগুলোর মুনাফার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তারা খবর দেবে ‘শ্রেণী বিন্যাসিত’ ঋণের ওপরও। এর ওপর ভিত্তি করেই কেউ কেউ হয়ত বলতে শুরু করবে ব্যাংকের ‘খেলাপী ঋণের’ পরিমাণ দারুণভাবে বেড়ে গেছে। গত বছর ছিল মোট ঋণের এত শতাংশ, ২০১৪ সালে হয়েছে এত শতাংশ। এর ওপর ভিত্তি করে হয়ত বলা হবে ব্যাংকগুলোর ‘দুরবস্থার’ কথা। বলবে এর জন্য ব্যাংকের মালিকরা দায়ী- এর জন্য বোর্ড দায়ী- ইত্যাদি ইত্যাদি অথচ কেউ খোঁজই করবে না যে শ্রেণী বিন্যাসিত (ক্লাসিফাইড) ঋণ মানেই ‘খেলাপী ঋণ’ (ডিফলটেড লোন) নয়। শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণ মানে নিয়মানুসারে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণকে কয়েকটা শ্রেণীতে ভাগ করে- স্পেশাল মেনশন এ্যাকাউন্ট (এসএমই), সাব-স্টান্ডার্ড, ডাউডফুল এবং ব্যাড এ্যান্ড লস। সবচেয়ে ভাল ঋণ যেটা তাকে অবশ্যই বলা হবে স্টান্ডার্ড ঋণ। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মেনে করা হয় এবং এটা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। চলমান প্রক্রিয়া। ‘এসএমএ’, সাব-স্টান্ডার্ড হবে, সাব-স্টান্ডার্ড ডাউটফুল হবে; আবার ডাউটফুল হবে ব্যাড এ্যান্ড লস। সর্বশেষটি হলেই একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষে তা খাতা থেকে ‘রাইট অফ’ করতে হবে, নিতে হবে আলাদা খাতায়, করতে হবে মামলা। এই প্রক্রিয়া উল্টোও হতে পারে ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ শ্রেণীকৃত ঋণ বা ডাউটফুল বা সাব-স্টান্ডার্ড ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত ঋণ হতে পারে। এই পুনঃতফসিলও হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুসারে। ব্যাংকাররা ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর আর্থিক অবস্থা দেখেশুনে ঋণচুক্তিতে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে অদলবদল আনে। ঋণ একটা চুক্তি। ঋণ বিতরণের আগে ঋণের অনেক শর্ত গ্রাহককে মেনে নিতে হয়। দিতে হয় জামানত-প্রাইমারি ও কোলেটারেল। ওই চুক্তিতেই থাকে ঋণ কবে কবে কিভাবে পরিশোধিত হবে। ওই ‘শিডিউল’ মোতাবেক ঋণের টাকা পরিশোধ করা না হলেই ব্যাংকের ভাষায় খেলাপী ঋণ হয়। ব্যাংকের ভাষা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষা। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংকের ভাষায় একে খেলাপী ঋণ বলা হলেও অর্থাৎ ঋণটি শ্রেণী বিন্যাসিত হলেও আইনের ভাষায় তা খেলাপী হয় না। আইন বলে ছয় মাস একটা ঋণ ‘ওভারডিউ’ (ডিউ হবে তফসিল অনুযায়ী) থাকলে তা হবে ‘খেলাপী ঋণ’। গ্রাহক হবে ‘খেলাপী ঋণ গ্রহীতা’। মজা হচ্ছে খেলাপী না হয়েও বর্তমান নিয়মে একটা ঋণ ‘এসএমএ’ শ্রেণীভুক্ত হতে পারে। হতে পারে সাব-স্টান্ডার্ড। শুনেছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাকি ‘ডাউটফুল’ স্টাটাসেরও হতে পারে। এতে ফল কী? ফল হচ্ছে ব্যাংকের খাতায় গ্রাহক ‘শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের’ গ্রাহক, কিন্তু আইনত তিনি ‘খেলাপী’ নন। এতে ব্যাংকের বোঝা বাড়ে, কারণ ব্যাংককে ওই ঋণের বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখতে হয় ‘প্রফিট’ থেকে টাকা কেটে অথচ গ্রাহক রয়ে যাচ্ছে ‘অখেলাপী’, তার আরও ঋণ নিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তার ঋণ পাওয়ার কথা নয়। এ সব অসঙ্গতি হচ্ছে বর্তমান নিয়ম-বিধি-আইনের ফলে। এটা ব্যাংকগুলোর জন্য বিরাট সমস্যা। এ সমস্যার কথা যখন ‘মিডিয়ার’ একাংশের কাছে যায় তখন তারা খেলাপী ঋণের তথ্য অতিরঞ্জিত করে ছাপে। শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণই হোক আর খেলাপী ঋণই হোক, তা হ্রাস করার বর্তমান ব্যবস্থা হচ্ছে ঋণ পুনঃতফসিলকরণ (রিশিডিউলিং)। ১৯৯০-৯১ সালের আগে এ রকম কোন বিধি ছিল বলে আমার জানা নেই। গত বিশ-পঁচিশ বছরে ঋণ পুনঃতফসিলকরণ বা রিশিডিউলিংয়ের নীতিমালা কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এখানে তিনটি বিষয় পাশাপাশি চলেÑ প্রথমে ঋণ শ্রেণী বিন্যাসকরণ প্রক্রিয়া (ক্লাসিফিকেশন পলিসি), প্রভিশনিং পলিসি এবং জামানতের মূল্যায়ন নীতি, তৃতীয়ত পুনঃতফসিলকরণ প্রক্রিয়া। সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ইত্যাদি করা হয়েছে এবং সব সময়ই বলা হচ্ছে এসব করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী। বলা যায় ফিন্যান্সিয়েল সেক্টরের বিশ্বায়ন অর্থাৎ স্কুলের ‘ইউনিফরম’ পরার মতো। পছন্দ হোক আর না হোক সকলকে একই পোশাক পরতে হবে। অতএব শ্রেণী বিন্যাসকরণের সঙ্গে যোগ হয় ব্যাংকের পুঁজি নির্ধারণের বিষয়টিও। যত বেশি খেলাপী বা শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণ, তত বেশি পুঁজির প্রয়োজনীয়তা। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘রিশিডিউলিং’। ঋণের টাকা পরিশোধের ‘শিডিউলে’ পরিবর্তন অর্থাৎ গ্রাহককে সময় দেয়া, বেশি সময় দেয়া। প্রয়োজনে তার বোঝা হ্রাসের জন্য সুদ মওকুফ করা। এরও নীতিমালা করে দেয়া আছে। যখন এ সবের কিছুই কাজ করে না, তখন ঋণ ‘ব্যাড এ্যান্ড লস’ হয়, মামলা হয় অর্থঋণ আদালতে। ‘পুনঃতফসিলকরণের’ আগে কোন সীমা ছিল না। একটা ঋণ একবার-দুইবার থেকে দশবার, বারোবারও পুনঃতফসিল করা যেত। ধারণা হলো যে এতে পুনঃতফসিলকরণের মর্মার্থটুকু ভুলে যাওয়া হচ্ছে। এটি বন্ধ করা বা পুনঃতফসিলের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য এর সীমা বেঁধে দেয়া হলো। এখন সর্বোচ্চ তিনবার একটা ঋণ পুনঃতফসিল করা যায়। এখানেই বেধেছে গোল। বছর দুই আগে এই সীমা বেঁধে দেয়ার পর দেখা যাচ্ছে বহু ঋণ ইতোমধ্যেই দুইবার পুনঃতফসিল করা হয়ে গেছে। অনেক ঋণ তিনবারও পুনঃতফসিল হয়েছে। প্রশ্নÑ এরপর কী? আবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে যে বিধিমালা করা আছে তাও অনেক গ্রাহক পরিপূরণ করতে পারছে না। যেমন ‘ডাউন পেমেন্ট’। পুনঃতফসিলকরণের অন্যতম শর্ত আটকা পড়া টাকার ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট করতে হবে। আবার সময়সীমাও বেঁধে দেয়া আছে। ঋণভেদে সময়সীমা হচ্ছে ৯ মাস থেকে তিন বছর। দেখা যাচ্ছে এই সময়সীমার মধ্যে গ্রাহকদের অনেকেই টাকা পরিশোধের ক্ষমতা রাখেন না। অতএব, করণীয় কী? করণীয় আছে ‘ডাউন পেমেন্ট’ অপারগতা হলে অথবা সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে ওই সমস্ত ঋণের পুনঃতফসিল প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে কার্যকর করতে হবে। এখানে সৃষ্টি হচ্ছে আরেক সমস্যা। দেখা যাচ্ছে ঋণ বিতরণ, ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফসিলকরণের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠছে। এটাই ‘পাওয়ারের’ অনুষঙ্গ। যেখানেই ‘পাওয়ার’ সেখানেই অনিয়মের অভিযোগ হয়। ঋণ পুনঃতফসিল প্রক্রিয়াকে ‘টাইট’ করতে গিয়ে, মনিটর করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তার কাছে যে ‘পাওয়ার’ সংরক্ষিত রেখেছে, তা ব্যবহারে ‘অনিয়ম’ হচ্ছে বলে অভিযোগ বাজারে। এটা সত্যি হলে তা গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ দেশে একটা। এটা একটা ‘ইনস্টিটিউশন’। এর ভাবমূর্তি নষ্ট হলে আর্থিক খাতের প্রচ- ক্ষতি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ‘পাওয়ার’ সংরক্ষিত রাখবে কী রাখবে না, এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করবে বলে আশা করি। বিষয়টি গবর্নরের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমার ধারণা তিনি এ বিষয়ে সজাগ। প্রশ্নটি শুধু ‘পাওয়ারের’ নয়। অবস্থাদৃষ্টে এবং বাস্তবতার আলোকে মনে হয় ঋণ ক্লাসিফিকেশন পলিসি, প্রভিশনিং এবং জামানত নীতিমালা, ক্যাপিটেল এডিকোয়েসি রেশিও, রিস্ক ওয়েটেড এ্যাসেট নির্ধারণ নীতি এবং ঋণ পুনঃতফসিলকরণ নীতিমালা ইত্যাদি বিষয়ই পুনঃবিবেচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে উন্নীত হওয়ার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ শক্ত নীতিমালা মনে হচ্ছে কাজে আসছে না। ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা তো নয়ই। পুরো বিষয়টাকে ‘অঙ্কে’ (এরিথম্যাটিক) পরিণত করা হয়েছে। নীতিমালা ব্যাংক পরিচালনার জন্য, তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য। ব্যাংক মানে গ্রাহক-আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা। এই ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভাল থাকলে ব্যাংক ভাল থাকে, তারা মরলে ব্যাংক মরে। ব্যবসা ভাল থাকলে, বাণিজ্য-শিল্প ভাল থাকলে ব্যাংক ভাল থাকে। ব্যবসার অবস্থার ওপর ব্যাংকের পারফরম্যান্স নির্ভর করে। ব্যবসা ‘অঙ্ক’ দিয়ে চলে না। যে ‘শিপবিল্ডিং’ ব্যবসাকে আমাদের ‘মিডিয়া’ গার্মেন্টসের মতো সম্ভাবনাময় খাত বলে বর্ণনা করেছে আর ব্যাংকগুলো ছুটেছে তার পেছনে ওই শিল্পের অবস্থা কী? ব্যবসা যদি অঙ্ক হতো তাহলে শিপবিল্ডিং শিল্পের জন্য আমাদের এখন ভুগতে হতো না। অঙ্কের হিসেবে যে ঋণ ৩১ ডিসেম্বরে ভাল ঋণ, তা মার্চে খারাপ হয়ে যেতে পারে আবার উল্টোটাও হতে পারে। অতএব, বাংলাদেশ ব্যাংককে বলব ওপরে আলোচিত বিষয়গুলোকে সামগ্রিকভাবে দেখতে। ছোটবড়, মাঝারি ব্যবসা কেমন চলছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে। বড়রা ‘ওভার ইনডেটেড’ কিনা, ছোটরা ‘আন্ডার ইনডেটেড’ কিনা তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। পুনঃতফসিলকরণের নীতিমালা পুনঃবিবেচিত হোক। বাস্তবতাকে আমলে নেয়া হোক। অঙ্কের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় ব্যবসার অবস্থার নিরিখে ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নীতিমালা পুনঃবিবেচনা করা দরকার বলে মনে করি। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×