ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এই যুগেও ক্রীতদাস!

প্রকাশিত: ০৩:২১, ১ জানুয়ারি ২০১৫

এই যুগেও ক্রীতদাস!

দাস প্রথা বা ক্রীতদাস প্রথা সে তো অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই ডিজিটাল যুগে সারা বিশ্বে চলছে আধুনিক দাস প্রথা। বিশ্ব ক্রীতদাস সূচক-২০১৪ সংক্ষেপে জিএসআই জানায়, বর্তমানে বিশ্বের ৩ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ ক্রীতদাসের মতো জীবন যাপন করছে। অমানবিক পেশায় যারা যুক্ত তাদেরই ‘আধুনিক যুগের ক্রীতদাস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দাসত্ব বলতে বোঝায় কোন মানুষকে জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এ ক্ষেত্রে কোন মানুষকে অন্য মানুষের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা। অমানবিক ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, ‘দাসত্ব যদি অন্যায় না হয়, তাহলে পৃথিবীতে অন্যায় বলে কিছু নেই’। ক্রীতদাস প্রথা প্রাচীন যুগে ছিল। মধ্যযুগেও ছিল। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) ক্রীতদাস হযরত বেলালকে (রাঃ) মুক্ত করেছিলেন। সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোসহ বিশে^র বিখ্যাত দার্শনিকগণ ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। স্পারটাকাসসহ তার অনুসারী ৬ হাজার জনকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ক্রীতদাস প্রথার বিরোধিতাকারী স্পারটাকাসের প্রশংসা করায় সক্রেটিস গ্রীক সম্রাটের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। রাশিয়ার জারদের হাত থেকে ক্রীতদাস ক্ষেতমজুররা মুক্তি পেয়েছিল রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে। তলস্তয়, লেনিন, মাও সেতুং, মহাত্মা গান্ধীসহ বিশ^নন্দিত নেতারা ক্রীতদাস বা দাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। স্পারটাকাস, নাট টারনার, হ্যারিয়েত তুবম্যান, সুজারনার টুথসহ অসংখ্য ব্যক্তি ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন। আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির জন্য গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জয়ী হয়েছেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন তাদের জরিপে দাবি করেছে, বাংলাদেশে আধুনিক দাসের সংখ্যা সাত লাখ। এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৪৩৫ ভাগ। বৈশি^ক সূচকে ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯তম। সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস ভারতে এবং জনসংখ্যার শতকরা হারে আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া। ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলেও ঋণের জালে আটকানো, জোরপূর্বক শ্রম, অর্থের বিনিময়ে যৌন চাহিদা মেটানো ও জোরপূর্বক বা বাধ্যতামূলক বিয়ে এবং ভিক্ষার পাশাপাশি ইটভাটা, চিংড়ি শিল্প ও গার্মেন্টসে কর্মরতদের দাসের তালিকায় ফেলা হয়েছে এই সূচকে। এই জরিপে আরও বলা হয়েছে, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেই এই সমস্যা বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেসরকারি খাতে ‘অভাবনীয়’ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পরেও বাংলাদেশের মানুষ ‘আধুনিক দাসত্বের’ ঝুঁকিতে আছে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে বেশি ক্রীতদাস। সেখানে দাস হিসেবে জীবন-যাপন করে এক কোটি ৪০ লাখ লোক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশে^ বলপূর্বক শ্রম থেকে দেড়শ’ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হয়ে থাকে। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোতে এই দাসদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে শ্রম আদায় করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের গার্মেন্ট শিল্প, চিংড়ি ঘের ও কৃষিকাজে স্বল্পমূল্যে শ্রম শোষণ করা হয়। বর্তমান বিশে^ এখন প্রায় ৩ কোটি ৫৮ লাখ দাস রয়েছে। এই সংখ্যা ইতিহাসের যে কোন সময়ের দাসের সংখ্যার তুলনায় বেশি। এমনকি প্রায় চারশ’ বছরের ইতিহাসে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় নেয়া আফ্রিকান দাসের মোট সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার আমরা যখন নিজেদের সভ্য বলে দাবি করছি তখনই বিশে^র ১৬৭টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে সব দেশেই ক্রীতদাসত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে মানবাধিকার সংস্থাটি দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জোরপূর্বক শ্রম নেয়াকে দাসত্ব হিসেবে গণ্য করে না। তাদের হিসাব অনুযায়ী এখন বিশে^র দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব ও দাসত্বসংশ্লিষ্ট প্রথার কাছে বন্দী। এই দাসের বেশিরভাগই ঋণ শোধের জন্য দাসে পরিণত হয়েছে। নারী ও শিশুদের যৌন ব্যবসায় খাটোনো হয়। এটিকে বর্ণনা করা হয় ‘ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দাস বাণিজ্য’ হিসেবে। অবৈধ মাদকদ্রব্য পরিবহনে ব্যবহার করার কারণে একই সঙ্গে এটি বিশে^র অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষেত্র। প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে সমাজে মানুষ বেচা-কেনার একটি প্রথা ছিল। যা দ্বারা বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে মানুষ কেনা যেত। এই প্রচলিত প্রথাটিকেই দাস প্রথা বলা হয়ে থাকে। সাধারণত দাস-দাসীরা আফ্রিকান হতো। আফ্রিকান দাস এর মধ্যে হাবশি ও কাফ্রি’র চাহিদা ছিল বেশি। বাংলায় এসব দাস-দাসী ৫ থেকে ৭ টাকায় কেনা যেত। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দাসকে কিনতে লাগত ২০/২২ টাকা। দাসদের দিয়ে দুই ধরনের কাজ করানো হতো, কৃষিকাজ ও গার্হস্থ্য কাজ। তখন দাস রাখা একটি সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার ছিল। তাছাড়া উচ্চবিত্তরা তাদের দাসদের দিয়ে বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজ করাত। যেমন, ঘানি ভাঙানো, আখ মাড়াই, হালচাষ, সেচের পানি, গবাদি পশু পালন, বৃক্ষাদির পরিচর্যা ইত্যাদি। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এবং আমেরিকার সরকার ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দাস-দাসী আমদানি ও রফতানি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে। গার্মেন্টস শ্রমিক, চিংড়ি ঘেরের শ্রমিক এবং নির্মাণ শ্রমিকদের অবস্থার যৎসামান্য উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। চা বাগানের শ্রমিকদেরও কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে হচ্ছে। তবে এখনও তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। যে কারণে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামের মধ্যেও ফেঁসে ওঠে শ্রমিকরা। এ ছাড়াও কাজ দেয়ার কথা বলে নারীদের নিয়ে যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। শিশুশ্রম চলছে গার্মেন্টস, ওয়ার্কশপ, গণপরিবহনে। বাল্যবিয়ের ঘটনা এখনও ঘটছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে। দাসত্ব নির্মূল বা প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন কাজ। [email protected]
×