ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হে রণবীর লও, লও সালাম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪

হে রণবীর লও, লও সালাম

‘নতুন স্বদেশ গড়ার পথে তোমরা চিরদিন দিশারী হবে। আমরা তোমাদের ভুলব না।’ একটু ঘুরিয়ে, একটি মাত্র শব্দ বদলে যদি বলিÑ তুমি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা তোমায় ভুলব না। তাহলে কি সেই গরীয়ান বাঙালী, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবন মন্ত্রদাতা সুমহান গীতি কবি গোবিন্দ হালদারের প্রতি জাতির অসীম কৃতজ্ঞতা সম্মান ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ যথোচিত ও যথার্থভাবে বিধৃত হবে? নিবেদিত কি হবে তিরিশ লাখ শহীদের, চার কোটি লাঞ্ছিত বোনের, কন্যা-জায়া-জননীর ও শত সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার এবং ষোলো কোটি দেশবাসীর হৃদয়সিক্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি? তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন সমাজ পাওয়ার আশায় এই কলঙ্কিত জীর্ণ সমাজটাকে সজোরে আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। বিদীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। বিচূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি যত জোরে আমরা আঘাত করেছিলাম সত্য সুন্দরের বধ্যভূমি, অত্যাচার বঞ্চনা বৈষম্যপীড়ন আর পাপের ভাগাড় আজব দেশ পাকিস্তানের ভিত্তিমূলে তার চেয়েও অনেক বেশি জোরে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলতে চাই শোষণের সূতিকাগার এই পূতিগন্ধময় সমাজটাকে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সুখী-সুন্দর সদয় সমতার সোনার বাংলার। বলেছিলেন, সোনার দেশ গড়তে আমার সোনার মানুষ চাই। তাঁর কাক্সিক্ষত তেমন একজন সোনার মানুষ জর্জ হ্যারিসনের দোসর গোবিন্দ হালদার চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। তিনি আমাদের প্রাণ উজাড় করে ভালবাসা দিলেন। মেধা উপুড় করে প্রাণ মাতানো রক্ত তাতানো রণজয়ী শব্দ দিলেন। গ্রেনেডের মতো মাইনের মতো ধ্বনি দিলেন। মনের তানপুরায় অগ্নিবীণার সুর দিলেন। গোবিন্দ হালদার আজন্ম সংগ্রামী এক মানুষ। প্রচ- লড়াকু। দারিদ্র্যের সঙ্গে, অভাবের সঙ্গে, অনটনের সঙ্গে, অপুষ্টির সঙ্গে, হয়ত ক্ষুধার সঙ্গেও এবং নিশ্চিতভাবে ওষুধ পথ্য পরিচর্যার অনটনে রোগ-ব্যাধির সঙ্গে অনেক লড়েছেন তিনি। লড়তে লড়তেই নিস্তেজ হয়ে এখন বার্ধক্যপীড়ায় নিথর। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়ত তাঁকে বাংলাদেশে এনে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক করে তুলতেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই জীবন সায়াহ্নে বাংলাদেশে অভিবাসিত করে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছিল। জাতির জনক বেঁচে থাকলে উজ্জীবন মন্ত্রের কবি অনন্য গীতিকার গোবিন্দ হালদার আমাদের জাতীয় সম্মান, বীরের মর্যাদা পেতেন। ১৩ নবেম্বর ’১৪, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কলকাতা জিতেন্দ্রনাথ রায় হাসপাতালে মৃত্যু শষ্যায় শায়িত কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন। ‘আপনি বাংলাদেশের সত্যিকার বন্ধু। আপনি অনেক গান লিখেছেন, আপনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন।’ এই নিরস কথাগুলো মহামান্য প্রেসিডেন্ট তখনই বলেছিলেন। এতে মৃত্যুপথযাত্রী অকৃত্রিম বাঙালীবন্ধু কতটুকু স্বস্তি পেয়েছেন, কতটা শান্তি পেয়েছেন, কতখানি সুখ পেয়েছেন তা আমি জানি না। তবে যদি আমরা তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করতাম, যদি তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে এনে যুদ্ধাপরাধীদের হটিয়ে যুদ্ধকবিকে একটু শুশ্রƒষা দিতাম, তাঁকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত নাগরিক বানাতাম তাহলে হয়ত তাঁর প্রতি বাঙালীর অশেষ কৃতজ্ঞতার কিয়দাংশ প্রকাশ করা যেত। সাগরকে এক গন্ডুষ জল দিলে আমাদের অগাধ ঋণ হয়ত কিঞ্চিত লাঘব হতো। সারা পৃথিবীতে যারা আমাদের সুহৃদ আছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সাচ্চা মিত্র আছেন, প্রকৃত দোস্ত আছেন তাঁদের অনেককেই আমরা সোনার পাথর বাটি দিয়ে পিতলা সম্মাননা দিয়েছি। গোবিন্দ হালদারের হৃদয় তখনই হয়ত আশাভঙ্গের বেদনায় বিদীর্ণ হয়েছে। সেই ভগ্নহৃদয় আর উজ্জীবিত হয়নি। আমরা তো পিতৃহন্তা জাতি। আমরা কী কৃতঘœ হলাম? তবে, কিছু যদি আমরা নাও করে থাকি সেই মহান মানুষটির জন্য, তবু তাঁর রেখে যাওয়া বাণী নতুন যে কোন সঙ্কটে বাঙালীকে একাত্তরের মতোই প্রেরণা দেবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ আবার ঈষাণ কোণে বিষাণ বাজে। দিগন্তে দৃশ্যমান হয় ঝড়ো মেঘের আনা গোনা। আকাশে শকুনের ঝাপ্টা উদ্বেগ জাগায়। এ সময় অমর গীতি কবি গোবিন্দের বাণী ‘আর দেরি নয়/উড়াও নিশান/রক্তে বাজুক প্রলয় বিষাণ/বিদ্যুৎ গতি হউক অভিযান/ছিঁড়ে ফেলো সব জাল/শত্রু জাল শত্রু জাল’ আমাদের আনচান প্রাণে আবারও উন্মাদনা জাগাবে। সংগ্রামের প্রেরণা ও প্রতিরোধের শক্তি এনে দেবে। সমরের সাহস এনে দেবে। এ বিশ্বাসে আমি অটল। হে সহযোদ্ধা, হে শব্দসৈনিক হে রণসাথী হে বন্ধু, তোমার অসামান্য র্কীতিতে বাঙ্গালী জাতি তোমাকে আজীবন স্মরণ করবে। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’ ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা।’ বাঙালীর অত্যন্ত প্রিয় দুটি গান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ও বিজয়ের পরে কোটি কণ্ঠে গীত হয়েছে। বাঙালীর রক্তে নিরন্তর প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছে। দেশপ্রেমের অনল প্রবাহকে বেগবান করেছে। রণাঙ্গনে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হয়েছি। উদ্বেলিত হয়েছি। উজ্জীবিত হয়েছি। উদ্বুদ্ধ হয়েছি। প্রাণিত হয়েছি। জাতির ঋণের তাই সীমা নেই। বাঙালী ৪৭ থেকে ২৩ বছর এক মায়াবী মন্ত্রজালে আবদ্ধ ছিল। আপন ভুবনে ছিল পরবাসী। প্রতারণার বন্দীশালায় ৫৬ শতাংশ বাঙালী জাতীয় সম্পদের নায্য হিস্যা পায়নি। ভাষার অধিকার পায়নি। সামরিক বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা সর্বত্র বঞ্চিত হয়েছে। প্রবঞ্চিত হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ ঔপনিবেশিক যুগের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। তবুও কেবল ধর্মের ছলনায় পূর্ববাংলা আটকে ছিল বিবাদ বিসম্বাদের অসুখী সংসারে। ২৩ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেরানী সদৃশ নতশির বাঙালীকে লড়াকু চির উন্নত শির বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন।’ সারা বিশ্বের বাঙালী এখন বুক চেতিয়ে বলে আমি বাঙালী আমরা বাঙালী। তুমি বাঙালী তোমরা বাঙালী। আসো আমরা এক সঙ্গে গাই প্রাণের সেই গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ পাশের বাড়ির খোট্টারা তখন আঁতকে ওঠে। আমার মায়ের ভাষাকে খুবলে খেতে চায়। আমার সংস্কৃতির ওপর হামলে পড়ে অসীম স্পর্ধায়! গোবিন্দ হালদারের ‘বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল//হয়েছে কাল//হয়েছে কাল’, রণোদ্দীপিত বীর বাঙালীকে বুকের পাঁজর দিয়ে দানরক্ষীর অবরোধ গুঁড়িয়ে সিংহদ্বার ভেঙ্গে যক্ষের কারাগার থেকে বন্দী স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার প্রেরণা যুগিয়েছে। কবির উজ্জীবন বাণীÑ ‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে//অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে//রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে//নয়া বাংলার নয়া সকাল//নয়া বাংলার নয়া সকাল’, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সঠিকভাবে ধারণ করে। ‘জোযার এসেছে জন সমুদ্রে// রক্ত লাল রক্ত লাল’ জনযুদ্ধের স্বরূপকে উদ্ভাসিত করে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা জনগণ। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ও পেশাজীবী অগণন গণমানুষ। দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য, আনসার পুলিশ সীমান্তরক্ষী জনগণেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি ছিল হাড্ডিসার কৃষক শ্রমিক জনতা। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে//রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল//জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে //রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল’ গানের অমিত শক্তি জনযুদ্ধের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। গীতিকবি গোবিন্দ হালদার জাতির জনকের রণপ্রেরণাকে যুতসই শব্দ বিন্যাসে বাঙ্ময় করেছেন। শত্রুর বুকে শেল হেনেছেন। তিনি মায়ের স্নেহ ডোরে বাঁধা বাংলা ভাষাকে প্রণয়ের ভাষা থেকে রণের ভাষায়, সংগ্রামের ভাষায় রক্তের ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন। গানের ছন্দে ছন্দে ভেসে তিনি আমাদের স্বাধীনতার পথিকৃৎ হয়ে উঠেছেন। জাতি ঋণী। তাঁর মহান স্মৃতিকে ধারণ করে প্রেরণাকে স্মরণ করে তাঁকে আমরা বাতিঘর করে রাখব। বাঙালীর অসমাপ্ত বিপ্লবকে পূর্ণতা দিতে তিনি সংগ্রামের কণ্টকিত পথে আমাদের পাশে প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন। জাতি তাঁকে চিরকাল স্মরণ করবে। হে ব্যথিত বন্ধু মোর, হে মোর তৃষিত রণবীর, হে সারথী, হে রণসাথী তোমার জন্য তোলা থাকল বত্রিশ কোটি বাঙালীর শতকোটি সালাম। লহ শতসহস্র রণসঙ্গী সহযোদ্ধার লাল সালাম। তিরিশ লাখ শহীদের শুভাশীষ। তুমি অমর হয়ে থাকবে। বাঙালীর প্রাণভোমরা, জাতির পিতা শেখ মুজিবের কাতারে তুমি সাঁজের প্রদীপ হয়ে রবে চিরকাল। সুকান্তের মতো, নজরুলের মতো গোবিন্দ হালদার তুমিও বাংলার আকাশে স্বাতী হবে, শুকতারা হবে। মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু, তোমার জন্য রইল বাঙ্গালীর প্রাণের শুভেচ্ছা। তুমি ভাল থাক, সুস্থ্য থাক। লেখক : ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট
×