ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বীরাঙ্গনাদের কথা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করুন

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪

বীরাঙ্গনাদের কথা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করুন

আরাফাত মুন্না ॥ বীরাঙ্গনারা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জাতির অহঙ্কার। কারণ তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা। সমাজে তাদের গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। মঙ্গলবার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদ- দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন। আজহারের নির্যাতনের শিকার এক বীরাঙ্গনা নারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন প্রসিকিউশন। আজহারের বিরুদ্ধে ওই বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলে স্থাপিত পাকিস্তানী ও রাজাকার ক্যাম্পে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আজহারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে এ ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানায় প্রসিকিউশন। তবে আইনে না থাকায় সরাসরি ক্ষতিপূরণ না দিতে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য বলেন। পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার নিশ্চিতে দ-বিধির সহযোগিতা নিতে পারেন। ৭৩ সালের আইনের ২০(২) ধারা দ-বিধির ৫৩ ধারা অনুসারে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সে অনুসারে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ-, সশ্রম বা সাধারণ দ-, সম্পত্তি বাজেয়াফত বা জরিমানা করতে পারে। ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অপরাধী থেকে অপরাধের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেয়ার বিধান আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩-এ বা দ-বিধির কোথাও পাইনি। শুনানিতে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজও এতে একমত পোষণ করেছেন। এ কারণে আমরা আসামি এটিএম আজহারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে একাত্তরে যৌন সন্ত্রাসের শিকার রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষীকে দেয়ার আদেশ দিতে পারিনি। কিন্তু আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিত আর দেরি না করে এই বীরাঙ্গনাসহ সব বীরাঙ্গনাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা। কারণ তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা। সমাজে তাদের গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও জাতির অহঙ্কার। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ উচিত। যাতে প্রজন্মের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। যাতে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, পাকিস্তান দখলদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের যৌন সন্ত্রাসসহ বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারে। ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, এটা এখানে উল্লেখ করা যায় যে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাকে হত্যার পর বিস্ময়করভাবে এটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সামরিক শাসকদের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানী জান্তার সহযোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা আমাদের দেশের জাতীয় বীর। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আজ আমাদের সময় এসেছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার। ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেয়ায় এ মামলার এক বীরাঙ্গনার সাহসিকতার জন্য স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল। এটি বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাষ্ট্রকে দেয়া ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ। এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বীরাঙ্গনাদের পাশাপাশি যুদ্ধশিশুদেরও তালিকা তৈরি করে তাদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু ও পুনর্বাসন করতে রাষ্ট্রসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ওই রায়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগী বাহিনী গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার কায়সারকেও সর্বোচ্চ দ-াদেশ দেয়া হয়। কায়সারের যুদ্ধাপরাধ মামলায় প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেয়া ধর্ষিতা হয়ে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া একজন যুদ্ধশিশু ও দুই বীরাঙ্গনাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেছিলেন প্রসিকিউশন। ৪২ বছর বয়সী নারী যুদ্ধশিশু দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কায়সারের বিরুদ্ধে।
×