ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

কূপম-ূক, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার সমাধিস্তূপের ওপর অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ আর শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালী জাতির অমর অভিযাত্রিক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মা মাটি মানুষ এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৪৮ সাল থেকে যে ক্লান্তিহীন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তারই অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে কলকাতার নবাব সিরাজউদ্দৌলা হলের এক সভায় (২৩ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ভাইসব, এ স্বাধীনতা আমাদের কোন কাজে আসবে না। যত শীঘ্র সম্ভব চলুন আমরা ঢাকা ফিরে যাই; আরেকটি সংগ্রামের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশে ফিরে এসে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িকতার নামাবলি ছুড়ে ফেলে দিয়ে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগে অসাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এ দেশের মানুষকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে। ’৬২-এর হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনই ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করতে সাহায্য করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠার মূল লড়াই করেছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তিতুমী, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর সফল পরিণতি এনে দিয়েছেন বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষের বিরাটত্ব বিশালত্ব কিসের নিরিখে নির্ধারিত হয় তবে? তার অনন্যসাধারণ কর্ম, অসাধারণ প্রত্যয়, পরিণামদর্শিতা, দূরদৃষ্টি এবং সর্বোপরি মানুষ হিসেবে ঔদার্যের ভিত্তিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রকৃত অর্থে ক্ষণজন্মা এক যুগপুরুষ যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলার চিরায়ত মুক্তিকামী মানুষের শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা থেকে মুক্তিদানের লক্ষ্যে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে অকপটে। তুলনাহীন এই স্থপতি শুধু কেবল বাংলাদেশ তৈরি করেননি বরং তিনি ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও চৈতন্যগত কাঠামো। দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্ব সভায় স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর অমোঘ আত্মবিশ্বাস তিনিই প্রথিত করে গেছেন দুঃখিনী বাংলা জননীর রক্তপ্রবাহে। বঙ্গবন্ধ তাই অমূল্য পরশ পাথরের সমার্থক, অবিনশ্বর স্থাপত্যের স্থপতি, বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের অমর মহাকবি। তার অমর স্থাপত্যের নাম কি? তার নাম বাংলাদেশ, যাকে তিনি তিল তিল করে নিজের মেধা, শ্রম, বিপ্লব, ভালবাসা, সাহস ও অতুল্য বিরত্ব দিয়ে নিমাণ করেছেন। আমরা যারা তার উত্তরসূরি, আজ স্বাধীন দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা, আইনের শাসন, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বিশ্ব সভায় দৃঢ় আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে মাথা উঁচু করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে অনমনীয় প্রত্যয় বাংলাদেশ দেখাচ্ছে এই একুশ শতকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তার আদিবীজ রোপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতেই। পাকিস্তানী শোষকের কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে এলে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়, সেখান থেকে দিল্লীর পালাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ’, ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরাসহ অনেকে এসেছিলেন। ইতিহাসের এই মহানায়ককে সংবর্ধনা জানাতে, যিনি শুধু স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের অতুলনীয় স্থপতিই নন, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য অনুসরণীয় অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আজ সংঘবদ্ধভাবে কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়কে আবার নোংরামি দিয়ে কালিমালিপ্ত করতে চায়; তারা সর্বজনগ্রাহ্য ইতিহাসকে ভূলুণ্ঠিত করে কলঙ্কিত করতে চায় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সব অর্জন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। ওরা সেটেলড ম্যাটারকে আনসেটেল করতে চায়। ত্রিশ লাখ বাঙালীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রগতির এ রথযাত্রাকে পেছন দিকে ঘোরাতে চায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যে সম্যক বিশ্লেষণ করেছেন তাতে বিধৃত হয় এক অসামান্য সমাজ নিরীক্ষক, রাষ্ট্রনায়ক ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদ ছিলেন। তাঁর অটুট দেশপ্রেম, দেশের জনসাধারণের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা, জনগণের অসীম শক্তির প্রতি নিষ্ঠা এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের তাৎপর্যপূর্ণ নজির, তা তুলনা হয় না। প্রথমত পাকিস্তানী বর্বর শাসকদের অসহনীয় শোষণ, বঞ্চনা থেকে দরিদ্র ও নিপীড়িত একটি জাতির স্নায়ুতে বিপ্লবের শোণিত সঞ্চারিত করা, তাদের অসম সাহসিকতায় বলীয়ান করে চূড়ান্ত মুক্তির পথে এগিয়ে নেবার ক্ষমতা কেবল এই তেজস্বী মহানায়কের ছিল। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে বিনির্মাণের যে সীমাহীন কষ্ট, তার সবকিছুকে বরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সমাসীন ও আগামী প্রজন্ম ঠিক কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে বঙবন্ধুকে? সে প্রশ্ন আজ এক অনিবার্য অভিঘাতের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। যে অনির্বাণ অক্ষয় প্রেরণা, যে মৃত্যুহীন চেতনার নাম বঙ্গবন্ধু, তাকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা ও তার আদর্শ বাস্তবায়নের মাঝে নিহিত আছে বাংলার আপামর মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি; কেননা বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রূপকার, স্বপ্নদষ্টা। লেখক : সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য, ঢাবি
×