ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ॥ ২০১৪

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

একটি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ॥ ২০১৪

চলে যাচ্ছে ২০১৪। আর সব বছরের মতো ২০১৪-ও কম ঘটনাবহুল ছিল না। ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন বা রাজনৈতিক জীবনÑ আমি নিশ্চিত, প্রতিটি মানুষই এই তিন জীবনে উল্লেখযোগ্য অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন ২০১৪ সালে, যার কিছুটা সুখের, কিছুটা কষ্টের এবং অনেকগুলোই ব্যাখ্যাতীত রকমের যাতনার। কিন্তু তারপরও বছর কেটে গেছে বছরের নিয়মে। আসুন একটি কাজ করা যাক, আমাদের জাতীয় জীবনে ২০১৪ সালে আমরা কতটুকু কি পেলাম তার একটি রাজনৈতিক হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। হয়ত অনেক কিছুই এখানে বাদ পড়বে, কিন্তু জীবনের সবকিছুই কী আমরা মনে রাখি? যতটুকু যা স্মৃতিতে আসবে তাই-ই বিশ্লেষণ করে দেখা যাক ২০১৪ সালে আমাদের কে কি দিলেন। বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিঃসন্দেহে পার করে আসা বছরটির সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে যে, এ ঘটনার কারণে আমরা একটি আপাতত হলেও শান্তিপূর্ণ বছরকে পেয়েছি। ২০১৩ সালের শেষ তিন মাসের কথা স্মরণে আনলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের চিত্র। কোথাও আগুন জ্বলছে, কোথাও রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, কোথাও রাস্তার মাঝখানে মাথা থেঁতলানো পুলিশের লাশ দেখতে পাই, কোথাও দেখতে পাই জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে একের পর এক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর। যেন বাংলাদেশের দখল নিতে চাইছে কোন দখলদার বাহিনী, যাদের কোন মায়াদয়া নেই, নেই কোন মনুষ্যত্ব, সরকারকে ফেলে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারলেই ওরা থামবে কেবল, তার আগে কাউকে মুক্তি দেবে না। এরকম ভয়াবহতার মাঝে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল মানুষের জীবনে খানিকটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনার মোক্ষম অস্ত্রের মতো। নতুন সংসদ বসল, মন্ত্রিসভা গঠিত হলো এবং দেশ আবার চলতে শুরু করল, ধ্বংসস্তূপের ওপর আবার সবুজ ঘাস গজাতে শুরু করল। অনেকেই এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, আখ্যা দিতে পারেন গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করার দিন হিসাবে ৫ জানুয়ারিকে, সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু দিনটি ছিল একটি নতুন জীবনদায়ী ঘটনার। স্বাভাবিকভাবে যারা নির্বাচন করেনি, নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছে মানুষ হত্যা করে, স্কুল পুড়িয়ে দিয়ে, তারা নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর পরই বুঝতে পেরেছে যে, কত বড় ভুল তারা করেছে। কারণ ২০১৪ আর ১৯৯৬ সাল যে এক নয়, সেটি তাদের মাথাতেও আসেনি। ফলে তারা বাংলাদেশের জনগণকে ছেড়ে বিদেশীদের কাছে ধরনা দিতে শুরু করে। একদিকে তাও খারাপ নয়, কারণ তাতে দেশের জনগণ অন্তত বাঁচে। এই বাঁচা কি করে তা একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন। অনেক ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গেই কথা বলে জেনেছি যে, ২০১৩ সালে তাঁরা কোন ব্যবসাতেই ঠিক জমাতে পারেননি। যে গার্মেন্টস শিল্প এদেশের অর্থনীতির এখন প্রাণ, সেই গার্মেন্টস শিল্পকে বিদেশী ক্রেতাকে ধরে রাখতে প্রাণান্ত হতে হয়েছে। কারণ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৈরি পোশাক তাঁরা পৌঁছাতে পারেননি বন্দরে। ফলে ২০১৪ সালে যখন পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করে তখন তাঁরা নতুন উদ্যোগে এইদিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করেন। ব্যবসায়ী সমাজ হাসিমুখেই এই আপাতত শান্ত পরিস্থিতিকে স্বাগত জানায়। শুধু ব্যবসায়ী সমাজ কেন, শ্রমিক, সাধারণ চাকরিজীবী, পেশাজীবী প্রত্যেকেই কী এই শান্তি কামনা করেননি? অবশ্যই করেছেন। নতুন সরকার আর যাই-ই করুক, দেশের জনগণকে কোনরকম পীড়া দিয়েছে বলে আমরা জানতে পাই না। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রেমিটেন্সের পাহাড় জমায় দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে, কমেছে সাধারণ জিনিসপত্রের মূল্য। সাধারণ মানুষের চাওয়া খুব বেশি নয়, তারা সাধারণভাবে খেয়েপরে বাঁচতে চায় কেবল, সরকার সে সুযোগটুকু রাখলেই মানুষ বর্তে যায় এবং তাই-ই হয়েছে। কিন্তু সরকারের কর্মকা-ে মানুষ যতটা না সুখী থেকেছে বছরজুড়ে ঠিক ততটাই অসুখী থেকেছে সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মকা-ে। বছরজুড়েই সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী থেকেছে সরকারী দল এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো। সুখে থাকতে ভূতে কিলানোর মতো প্রবাদকে সত্যি করেছে সরকার-সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের কিছু মন্ত্রী, এমপির অতিকথন, কখনও কখনও শত্রুতাসুলভ বক্তৃতা-বিবৃতি। বাংলাদেশের মতো দেশে কথামালার রাজনীতির হয়ত প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু দিন যে বদলেছে, এখন কেবল কথায় মানুষকে ভোলানো যায় না এ কথা রাজনীতিবিদগণ এখনও যে বুঝতে পারেননি সে কথা আমরা বছরজুড়েই প্রমাণ পেয়েছি সরকারের মন্ত্রী/এমপিদের কর্মকা-ে। এদিক দিয়ে আমাদের সবচেয়ে কম দুঃখ-কষ্ট দিয়েছে জাতীয় সংসদে বর্তমান বিরোধী দল। অনেকেই এই বিরোধী দলকে গৃহপালিত কিংবা অন্য অনেক কটু কথায় আক্রমণ করে থাকেন, কিন্তু একটি দিক আমরা কখনোই ভেবে দেখিনি যে, সংসদে উপস্থিত থেকে দেশের উন্নয়ন কর্মকা-কে ত্বরান্বিত করার কাজে বর্তমান বিরোধী দল যতটুকু সহযোগিতা করেছে অতীতে এরকমটি হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আজকে অন্যরকম হতো, তাতে কোন সন্দেহ আছে কী? শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করাটাই যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নয় এ কথা বর্তমান বিরোধী দল প্রমাণ করেছে। হয়ত অনেকেই এখানে পতিত স্বৈরাচারের প্রতি নরম মনোভাবের কারণে এসব কথার সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু আমরা এ কথাও যেন না ভুলি যে, এই সাবেক স্বৈরাচারী শাসকই জেলের ভেতর বসে এদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাঁর দলটি এখনও এদেশে সরকার গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে। নির্বাচকম-লী যদি স্বৈরাচার বা গণতন্ত্রের পার্থক্য ধরতে না পারে তাতে স্বৈরাচারের দোষ ধরার চেয়ে গণতন্ত্রের দৈন্যতার দিকটিই স্পষ্ট হয় বেশি। সে যাহোক, অনেক স্বস্তির কথা হলো, এবার অশান্তির কথা কিছু বলি। আমাদের মতো মানুষের মূল অশান্তি ছিল এ বছর যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর না হওয়া বা বিচার কার্যকর করায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি। আদালত প্রাঙ্গণকে যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সেখানে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে গিয়ে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করাটা ছিল খুবই কষ্টদায়ক। কারণ, এই রাষ্ট্র কারও দয়ার দান নয়, এই রাষ্ট্র অগণিত মানুষের আত্মদানের ফসল। এ ফসলকে রাজাকারী পোকা দিয়ে নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের আইন-অঙ্গনগুলো এখন ভরে আছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক-কারবারিদের দ্বারা। ফলে তারা সেখানে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত রাজাকারের পরিবারদের ডেকে নিয়ে গিয়ে বিচার ব্যবস্থাকে যতটা খাটো করা সম্ভব সেটুকু করেছে এবং আরও দুঃখজনক হলো দেশের মিডিয়া আবার তা ফলাও করে প্রচার করেছে। এদেশের মিডিয়ায় আমরা রাজাকার-রাজা গোলাম আযমের জানাজা সরাসরি সম্প্রচার হতেও দেখেছি। মিডিয়ার দায়িত্ববোধ নিয়ে সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি হওয়ার আগেই তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন এদেশের মিডিয়া-বিশেষজ্ঞগণ। কিন্তু এ বিষয়ে কাউকে আলোকপাত করতে শুনিনি। আমরা মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার নামে নিন্দা জানাতে দেখেছি মাহমুদুর রহমানের মতো ভয়ঙ্কর মিডিয়া-সন্ত্রাসীর জন্য, যিনি কিনা তরুণদের জাগরণকে মানুষের চোখে হেয় করার জন্য তাদের নাস্তিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য হেন মিথ্যার আশ্রয় নেই যা নেননি। কিন্তু হেফাজতের হাতে নারী সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হওয়া নিয়ে তাদের বিবৃতি চোখে পড়েনি কোনদিন। মজার ব্যাপার হলোÑ মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে একজন বিদেশী সাংবাদিকের নির্লজ্জ তামাশা এদেশে বাক স্বাধীনতার নামে পার পেয়ে গেছে, কেউ কোন প্রতিবাদ করেননি। যখনই আদালত তাকে ডেকে নামমাত্র শাস্তি দিয়েছে তখনই আবার আমাদের সুশীল বিবেক (?) বাক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে বলে বিবৃতিযুদ্ধে নেমেছেন। আজব এই দেশ, মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ফেনা তুলে ফেলেছেন এই বিবৃতিদানকারীদের কেউ কেউ, অথচ এই বিদেশী সাংবাদিকের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘মসকারি’র অধিকার রক্ষায় তারা আবার সোচ্চার হয়েছে দেশে-বিদেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখেছেন সে কারণেই একজন সাংবাদিক, তিনি দেশী হোন আর বিদেশী হোন, তাঁকে একটি জাতির জাতীয় গর্ব নিয়ে পরিহাস করার সুযোগ দিতে হবে এরকমটি যুক্তি হিসেবে কেউ যদি দাঁড় করাতে চান তাহলে তাঁকে কি বলা উচিত, আমি আসলে জানি না। যাহোক, অপ্রাপ্তির আরেকটি জায়গা উল্লেখ করেই আজকের লেখার ইতি টানব। এই যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দুই দশকে যে বৃহৎ মেরুকরণ ঘটে গেছে তা ২০১৪ একটি অন্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেটা কী রকম? সেটা এরকম যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান যে রাজনৈতিক দলটি গঠন করেছিলেন তা যে আসলে মওদুদীর জামায়াতে ইসলামীর বি-টিম তা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ বছর। সবচেয়ে বড় কথা, মুক্তিযুদ্ধ যে আসলে বিএনপির বিষয় নয় এবং এসব ঘোষক-টোষক যে কেবল কথার কথাই, দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এসব বলা তাও প্রমাণিত হয়েছে এ বছর। এবং সেটা প্রমাণ করেছেন বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক জিয়া। লন্ডনে বসে তিনি ইতিহাস ঘেঁটে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে হাস্যকর একটি ঘটনায় পর্যবসিত করেছেন এবং তার বক্তব্যকে বাস্তবায়ন করতে দেশে থাকা বিএনপি নেতৃত্ব মায় তার মা বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত যে ন্যক্কারজনক কাজ করছেন তাতে প্রমাণ হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের কোনই শ্রদ্ধাবোধ নেই। থাকলে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করতেন না। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট বাঁধা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তা মেনে নিতে অনেকেরই অসুবিধা ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবি করে আবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা, এসব দ্বৈততা রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই বাক্যই প্রমাণ করত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার’ ‘পাকবন্ধু’ বলে তারেক জিয়া মুক্তিযুদ্ধকে এতটাই অপমান করেছেন যে, তার আসলে কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত সেজন্য। বঙ্গবন্ধু তার কথায় খাটো হন না একটুও, কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে তার কথায় মুক্তিযুদ্ধ আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং শাস্তিটা সে কারণেই। এ বছর রাজনীতিবিদদের কাছে বাঙালী জাতির এটাই ছিল সবচেয়ে জঘন্যতম প্রাপ্তি। সারা বছর ধরে তড়পানি দেখলেও বছরের শেষে এসে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট আমাদের আবারও পোড়া লাশ উপহার দিয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য লাশের পাহাড় দরকার তাদের সে ইশারা তারা দিয়ে রেখেছে। আগামী বছর হয়ত তাও আমাদের উপহার দেবে তারা, আমরা সে ভয়ভীতি নিয়েই প্রবেশ করতে যাচ্ছি নতুন বছরে। দেখা যাক সরকার কি করে, তারা দেশের জনগণকে অপরাজনীতির আগুনে ‘বার-বি-কিউ’ হতে দেবে, নাকি শক্ত হাতে এই অপরাজনীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেবে। আমি নিশ্চিত যে, সরকার যদি শক্ত, কঠিন হাতে এসব দমন করে জনগণ তাতে কিছু মনে করবে না, বরং পোড়া লাশ না হয়ে প্রাণ নিয়ে দিনশেষে ঘরে ফিরে পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’মুঠো খেয়ে সুখে-শান্তিতে দিন পার করতে পারলেই জনগণ মনে করবে যে, দেশে একটি শক্তিশালী ও জনগণের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ঢাকা ॥ ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ [email protected]
×