ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আলবদর কমান্ডার আজহারের মামলার রায় আজ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

আলবদর কমান্ডার আজহারের মামলার রায় আজ

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন, আটকসহ ছয়টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। একই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের নবম সাক্ষী হাজী আব্দুল আজিজের জেরা সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার পরবর্তী সাক্ষীর জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে আজহারের মামলার রায় ঘিরে ট্রাইব্যুনাল ভেতরে ও বাইরে বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের রায়টি হবে ট্রাইব্যুনালের ১৫তম রায়। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর আগে রায় প্রদান করেছেন ৬টি। এটি হবে ট্রাইব্যুনাল-১ এর সপ্তম রায়। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ৮টি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের সাবেক নেতাসহ ১৪টি মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদ-সহ বিভিন্ন ধরনের দ- প্রদান করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২। এটিএম আজহারুল ইসলামের রায়ের পর আরও দুটি মামলার রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ থাকবে। পাশাপাশি দুটি ট্রাইব্যুনালে আরও নয়টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা আজহারুল ইসলামের রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের পর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করা হবে। আমরা যুক্তিতর্কে আসামির বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ প্রমাণ করতে সামর্থ্য হয়েছি। যুক্তিতর্কে সময় ট্রাইব্যুনালে আমরা আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- চেয়েছি। আশা করি আমরা কাক্সিক্ষত রায় পাব। জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম তদন্ত শুরু হয় ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল। ২৩ আগস্ট আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। প্রসিকিউশনপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। একই বছর আসামির বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, আটক নির্যাতনসহ ৬টি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামির বিরুদ্ধে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৬ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। প্রসিকিউশন পক্ষে মোট সাক্ষী প্রদান করেন ১৯। আর আসামিপক্ষে এক জন সাফাই সাক্ষী প্রদান করেছেন। চলতি বছরের ১৮ আগস্ট থেকে প্রসিকিউশন পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। আসামি ও প্রসিকিউশনের যুুক্তিতর্ক শেষে ১৮ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। এটিএম আজহারের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার ও শিশির মোঃ মুনির। প্রসিকিউশনপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, ‘এ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনপক্ষের আনীত সব কয়টি অভিযোগ প্রমাণে আমরা সক্ষম হয়েছি। আশা করছি তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- কামনা করছি। পাশাপাশি আজহারের নির্যাতনের শিকার একজন বীরাঙ্গনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। আজহারের মামলায় ওই বীরাঙ্গনা প্রথম সাক্ষী হিসেবে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলে স্থাপিত পাকিস্তানী ও রাজাকার ক্যাম্পে আজহারের নেতৃত্বে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। রংপুর টাউন হলকে নির্যাতন কেন্দ্রের পাশাপাশি একে রেপ ক্যাম্প উল্লেখ করে আইনী যুক্তিতর্কে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত নারীদের বিষয়ে রাষ্ট্র সব সময়ই নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সেখানে এই নারী ট্রাইব্যুনালে এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে কিভাবে ধর্ষিত হয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সাক্ষ্যে তিনি বলেছেন, কিভাবে তাকে ও অন্য নারীদের নির্যাতন করা হতো। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে আনীত একটি অভিযোগেরও কোন ভিত্তি নেই। প্রসিকিউশনপক্ষ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে তার অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশা করি তিনি খালাস পাবেন। এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে ৬টি অভিযোগ (চার্জ) আনা হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো। চার্জ-১ : অপহরণ, আটক, নির্যাতন দখিগঞ্জ শ্মশানে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা ও গণহত্যা ॥ একাত্তরে ২৪ মার্চ রংপুরের আইনজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণের পর আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন। পরে তাঁদের ৩ এপ্রিল শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। চার্জ-২ : ধাপপাড়া লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যা ॥ একাত্তরের ১৬ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ধাপপাড়ায় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে এটিএম আজহারুল ইসলাম এ হত্যাকা-ে অংশ নেন। ওই ঘটনায় শহীদদের মধ্যে ১৪ জনের নাম-পরিচিতি শনাক্ত করে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। চার্জ-৩ : হাজীপুর, ঝাড়ুয়াপাড়া এবং ঝাড়ুয়াবিলে হত্যা ও গণহত্যা ॥ ১৭ এপ্রিল রংপুরের ঝাড়ুয়াবিল এলাকায় নারকীয় গণহত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় প্রায় এক হাজার ২০০ জন মারা যান, যাঁদের মধ্যে ৩৬৫ জনের নাম-পরিচিতি পাওয়া গেছে। শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ, কেউ ওই হত্যাকা-ের ঘটনায় বাদ যাননি। হত্যাকা-ের শিকারদের মধ্যে ২০০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, যা প্রমাণ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ঐ হত্যাকা- চালানো হয়েছিল। চার্জ-৪ : কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক ও পরিবার অপহরণ, আটক হত্যা ও গণহত্যা ॥ একাত্তরের ৩০ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচান রায় ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায়কে পাকিস্তানী সেনারা দমদমা সেতুর কাছে নিয়ে হত্যা করে। চার্জ-৫ : রংপুর টাউন হল অপহরণ, আটক নির্যাতন হত্যা এবং গণহত্যা ॥ একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামি এটিএম আজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায় রংপুর শহর ও তার আশপাশ থেকে নানা বয়সী মেয়েদের ধরে এনে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর অফিসারদের ভোগের জন্য তুলে দেয়া হতো। রংপুর টাউন হলে মেয়েদের আটক রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রংপুর টাউন হলের পেছনে ইন্দারায় অনেক মা-বোনের লাশ পাওয়া যায়। চার্জ-৬ : অপহরণ, আটক নির্যাতন, অন্যান্য অমানবিক আচরণ ॥ একাত্তরের নবেম্বরের মাঝামঝি এবং ১ ডিসেম্বর অভিযুক্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের যোগসাজশে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে অপহরণ করে নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
×