ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হরতালের নামে আবার হত্যা আবার আগুন দিয়ে পোড়ানো

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪

হরতালের নামে আবার হত্যা আবার আগুন দিয়ে পোড়ানো

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কি অপরাধ এই দুই মহিলার। দুইজনই শিক্ষিকা। হরতালজীবী দুষ্কৃতকারীদের দৌরাত্ম্যে একজন নিহত হয়েছেন। অন্যজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কাকতালীয় হলেও দুজনের নামও একই ধরনের শামসুন্নাহার। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম ঝর্না নোয়াখালীতে হরতালকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর দুই সন্তানের জননী আরেক শামসুন্নাহার হরতালের আগের রাতে রবিবার রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায় সিএনজিতে হরতালজীবী দুষ্কৃতকারীদের দেয়া আগুনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই সন্তানসহ এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কাজীপাড়ার শামসুন্নাহারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে অয়ন আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আনিকা মায়ের সঙ্গেই সিএনজির আগুনে দগ্ধ। মেয়ের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মায়ের অবস্থাও প্রাথমিকভাবে আশঙ্কামুক্ত। তবে ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা হরতাল আহ্বানকারীসহ নাশকতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। যাতে ভবিষ্যতে হরতালের নামে কেউ এমন নৈরাজ্য চালাতে না পারে। এদিকে পেট্রোল বোমা হামলাকারীরা সরকারদলীয় নেতাকর্মী বলে বিএনপির তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে। গত শনিবার গাজীপুরে বিএনপির সমাবেশে নাশকতার আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা জারি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর প্রতিবাদে সোমবার বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। হরতাল চলাকালে সকাল ১০টার দিকে নোয়াখালীর মাইজদী পৌরবাজারে পিকেটারদের ঢিলের আঘাতে নিহত হন স্কুল শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম ঝর্ণা (৩৭)। আহত হন তাঁর স্বামী আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (আলিকো) কর্মকর্তা শাহজাহান সিরাজ। তাঁর মায়ের নাম লুৎফুন্নাহার। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানাধীন চরবাদাম এলাকার চর ফোরাগাছা গ্রামে। জন্ম ১৯৭৭ সালের ২৫ নবেম্বর। কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৯২ সালে কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি, ১৯৯৫ সালে একই বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৯৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস (ব্যাচেলর অব সোস্যাল সাইন্স) পাস করেন। শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে ২০০২ সালের ৬ আগস্ট সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার শেরেবাংলানগর থানাধীন ৮২ নম্বর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের ৬ তলা বাড়িতে অবস্থিত বেসরকারী তাওহীদ ল্যাবরেটরী স্কুলে। স্কুলটিতে অষ্টম শ্রেণী ছেলে-মেয়ে একত্রে পড়াশুনা করে। এর আগে তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিজ এলাকার মাদিয়া চরমনসা আমলীতলা রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। সুখের সংসার। দুই ছেলে। বড় ছেলে সিম্যান অষ্টম শ্রেণীতে আর প্রিন্স দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কর্মস্থলের কাছেই ঢাকার শেরেবাংলানগর থানাধীন পশ্চিম আগারগাঁওয়ের ২৩৭ নম্বর বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করছিলেন। স্কুলটির পরিচালক আব্দুল হালিম জনকণ্ঠকে জানান, নিহত এই স্কুল শিক্ষিকার শ্বশুরের মৃত্যু হয় এক মাস আগে। এছাড়া তার স্বামীর কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার তিনি স্কুল থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তিনি লক্ষ্মীপুরের একটি স্কুলে যোগদান করেন। আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা নোয়াখালী থেকে জানান, নিহতের স্বামীর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানাধীন পোড়াগাছা এলাকায়। সম্প্রতি ঢাকা থেকে নোয়াখালীতে তাঁর বদলি হয়। এজন্য ঢাকার বাসা থেকে তিনি স্ত্রী সন্তান ও মালামাল নিয়ে কভার্ড ভ্যানে নোয়াখালী আসছিলেন। মাইজদী পৌরবাজারের মোড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হরতালকারীরা গাড়ির দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে। ইটের আঘাতে শামসুন্নাহার মাথায় মারাত্মক জখম হয়। তাঁকে নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃতু ঘোষণা করেন। শামসুন্নাহারের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে দুই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। দুই পুত্রের গগণ বিদারী আর্তনাদে সেখানকার আকাশবাতাস ভারি হয়ে আছে। নিহতের পরিবার হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। এ ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলায় দুই ছাত্রদল নেতাসহ ৫ জনকে আটক করা হয়েছে বলে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান। রবিবার বিকেলে ঢাকার শান্তিনগরে ডাক্তার দেখিয়ে মিরপুরে মামার বাড়ি যাওয়া হলো না আরেক মানুষ গড়ার কারিগর স্কুল শিক্ষিকা শামসুন্নাহারসহ তার দুই ছেলে মেয়ের। মামার বাড়ির পরিবর্তে হরতালকারীদের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। শুক্রবার একমাত্র মেয়ে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আনিকা আক্তারকে (১৮) ডাক্তার দেখাতে হাতিয়া থেকে ঢাকার মিরপুর ৭ নম্বরে মামার বাড়িতে আসেন স্কুল শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম (৫০)। তার স্বামী ব্যবসায়ী জাবের উদ্দিন। তিনি হাতিয়া মডেল প্রাইভেট হাইস্কুলের শিক্ষিকা। তাঁরা নোয়াখালীর হাতিয়া এলাকায় বসবাস করেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে। বড় ছেলে মনসুরুল হক (৩০) এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তা। মা ঢাকায় আসায় ছোট ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া শহীদ রফিক জব্বার ছাত্রাবাসের ২১২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র তানজিমুল হক অয়ন (২৪) মামার বাসায় যায়। ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে মা একটি সিএনজিযোগে শান্তিনগরে যান। সেখানে ডাক্তার দেখান। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তারা আরেকটি সিএনজি নিয়ে ঢাকার মিরপুর ৭ নম্বরের মিল্কভিটা রোডের মামার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিএনজিটি মিরপুর কাজীপাড়া ফুটওভার ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে। যানজটের কারণে আস্তে আস্তে চলছিল গাড়িটি। এরপরই সবার ভাগ্যের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে। গলির ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হরতাল সমর্থক সন্ত্রাসীরা সিএনজিটিকে ফলো করে। তারা পেছন থেকে সিএনজিটির উপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। চালক দরজা খুলে দ্রুত নেমে যেতে সক্ষম হন। কাঁচের বোতলে বানানো পেট্রোল বোমা সজোরের সিএনটিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারা হয়। কাঁচের বোতল ভেঙ্গে পেট্রোল ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দ্রুত সিএনজিতে আগুন ধরে যায়। চালক নেমে যেতে পারলেও দরজা বন্ধ থাকায় অভাগা মাসহ দুই সন্তান ভেতরে আটকা পড়ে। পুরো সিএনজিটিতে তখন আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তাদের আর্তচিৎকারে জনতা সিএনজির দরজা ভেঙ্গে ফেলে। আহতদের উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলার এইচডিইউ (হাই ডেফিসেন্সি ইউনিট)-এর পুরুষ বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, অয়নের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করছেন। তাকে সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ অয়নের সহপাঠীসহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১০ শিক্ষার্থী। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে অয়নের চাচা ট্রান্সকম গ্রুপে কর্মরত জামশেদ (৪২) জনকণ্ঠকে বলেন, অয়নের শ্বাসনালীতে তাপ লেগেছে। শ্বাসনালীতে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে বলে চিকিৎসকদের প্রাথমিক ধারণা। অয়নকে অন্তত ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিনি আরও জানান, সকাল ১০টার দিকে অয়নের বোন আনিকাকে রিলিজ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তার অবস্থা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত। তবে অয়নের মা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন। তাঁকে বার্ন ইউনিটের ৫ তলায় স্মাইল কার্নিয়োফেসিয়াল ওয়ার্ডের ২ নম্বর বিছানায় চিকিৎসা চলছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকদের প্রাথমিক ধারণা। অয়নের চাচা আরও জানান, সকালেই হাসপাতালটির বার্ন ইউনিটের পরিচালক ডাঃ সামন্তলাল সেনসহ বিশেজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের দেখতে যান। প্রয়োজনীয় সব ধরনের চিকিৎসা দিতে তিনি নির্দেশ দেন। চিকিৎসকরা আন্তরিকার সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন বলেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে আগ্রহের কথা জানান। অয়নের বড় ভাই ও চাচার দাবি, তাদের কি দোষ ছিল? হরতালের নামে এমন নৈরাজ্য কেন? তারা হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে এজন্য সবাইকে সজাগ থাকার এবং সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। মা, ভাই আর বোনের এমন অবস্থায় দিশেহারা মনসুরুল হক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাটতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সজীবসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা বোমা নিক্ষেপকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
×