ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

বড়দিন আকাক্সক্ষার জয় হোক

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

বড়দিন আকাক্সক্ষার  জয় হোক

দীর্ঘ সময় অস্ট্রেলিয়া বসবাসের কারণে বা বিদেশে থাকার কারণে বড়দিনের উৎসবকে একান্ত নিজের বলে মনে হয় এখন। দেশে থাকতে বাড়তি ছুটির দিনে বাইরে এই উৎসবটির আমেজ ছিল বাক্সবন্দী। রেডিও টিভির বাইরে ক্রিস্টমাসের কোন জৌলুস বা আনন্দঘন উত্তেজনা দেশে চোখে পড়ে না। এর দুটো কারণ, প্রথমত খ্রীস্টান সম্প্রদায় জনসংখ্যার অনুপাতে ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী; শেষত, বৃহত্তর জনসংখ্যা অন্যদের বেলায় হয় উদাসীন নয়ত স্পর্শকাতর। তবে একদিক থেকে আমরা অন্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। যীশুর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা বা সম্মান আছে কি নেই বড় কথা না, আমাদের দেশে এদিনটি সরকারী ছুটির দিন। সরকারীভাবে দিনটিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর রেওয়াজও চালু আছে। গণতান্ত্রিক ও আধুনিক নামে পরিচিত পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের দ্বিতীয় নিবাসভূমি অস্ট্রেলিয়ায় এখনও অন্য ধর্মের কোন উৎসবে সরকারী ছুটির রেওয়াজ নেই। এটা আমাদের জাতীয় চরিত্রের একটা বিশেষ দিকও বটে, আচরণগত পার্থক্য বা সমাজ সাম্প্রদায়িকতায় পিছিয়ে থাকার পরও কিছু কিছু উজ্জ্বলতায় আলোকিত দেশ আমাদের। সাধারণ মানুষ এখনও ধর্মপ্রাণ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক, বড়দিনের উৎসব বা যে কোন সম্প্রীতির শুভ দিকটি নিয়ে খেলছে অল্প কিছু মানুষ ও ব্যর্থ রাজনীতি। আগে রাজনীতির কথায় আসি। মিডিয়ায় দেখলাম, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের এক ক্ষুদ্রাংশের সঙ্গে বড়দিনের প্রীতিবিনিময় করতে গিয়ে বলেছেন, দেশে কোন ধর্মের মানুষই নাকি শান্তিতে নেই। কেন তাঁরা শান্তিতে নেই? যদি সত্যিই তাঁরা অশান্তিতে থাকেন, সঙ্কট বা সে দুরবস্থা মোচনে খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের ভূমিকা কি? বিগত বছরে যীশুর জন্মদিন বা বড়দিনের আগে পরে কি করেছিল তাঁর দলের অনুসারীরা? এখনও তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন বা বিদেশে বসবাসরত তাঁর সন্তান যে অভব্য আচরণ ও উত্তেজক বক্তব্যে ভাষণ রাখেন, তাতে কি পবিত্র আত্মা যীশুর শান্তি বা সম্প্রীতির কোন চিহ্ন আছে? একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। রাজনীতি করলে কি মানুষ ও দলের চেহারা রংহীন, বর্ণহীন, গোত্রহীন বা আদর্শহীন একাকার কিছু হতে হয়? যাদের দল ও মতবাদ ধর্মীয় সম্প্রীতি অসাম্প্রদায়িকতা, উদারনৈতিক মনোভাববিরোধী তাঁরা যীশু, বুদ্ধ বা চৈতন্যের জন্মদিনে চুপ থাকলেই কি ভাল না? বড় অদ্ভুত রাজনীতি আমাদের। প্রচারে লিফলেটে, বক্তব্যের ভাষণে সমাজতন্ত্র ধর্মহীন মানবিকতা বা প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার দলের নেতারাই ‘বড়দিন’ বা এ জাতীয় উৎসবে সবার আগে বিবৃতি দিতে এগিয়ে আসেন। ধর্মহীন ফের ধর্মান্ধ উভয় দলের উত্তেজনা আর প্রচারের চাপে আসল মানুষ, নীতি বা আদর্শ চাপা পড়ে যায়। বলছিলাম যেসব মানুষের কথা যাঁরা কোন না কোনভাবে সমাজ ও দেশের বিবেক বা সে জাতীয় কিছু নামে পরিচিত। এরাও দেখি আজকাল অন্য ভাষায় কথা বলেন। সম্প্রতি স্বেচ্ছাকাফন পরিহিত এক ভদ্রলোক ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ¦ী’ নামে এক রচনায় পাকিস্তানের শিশুহত্যার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে অজান্তে নিজের পৃথ¦ী বা দুনিয়াটা যে কত ক্ষুদ্র তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে পাকিস্তান তালেবানদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে নাকি আরও লাশ পড়বে, আরও হত্যা ও রক্তপাতে ভাসবে পাকিস্তানের মাটি। খাঁটি কথা! কিন্তু এদিন ধরে ঘরে কালসাপ পোষা, জামাই আদরে রাখা, ট্রেনিং দেয়া তালেবানরা কি করল সেদিন? তারা কি পাকিদের ছাড় দিয়েছে? হিলারি ক্লিনটনের ভাষ্য পড়ে দেখলেই জানা সম্ভব কেন এই পরিণতি। একদিকে মার্কিনীদের প্রভু মানতে রাজি, অন্যদিকে পাকি পরিস্থিতিতে মার্কিননীতির বিরুদ্ধাচরণকারী মিডিয়া হয়ে লিখতে গিয়ে ‘কাফন কলামিস্ট’ মূলত খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর লেখায় তিনি মহামতি গৌতমবুদ্ধের অহিংস বাণী তুলে এনে বলেছেন, অবিচারই নাকি যাবতীয় ক্রোধের উৎস। তাই যদি হয় তাঁদের মতো মানুষরা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দোটানায় ভোগেন কেন? যে অনাচার ও অবিচার বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান এবং ইতিহাসকে বিকৃত করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা কেন বিপথগামী? জানি এসব প্রশ্নের উত্তর পাব না, তারপরও বলি, বড়দিনের প্রাকমুহূর্তে অহিংস বাণীর আড়ালে প্রচ্ছন্ন তালেবান বা জঙ্গী সমর্থনের বুদ্ধিবৃত্তিই আজ আমাদের বড় সমস্যা। ভদ্রলোক তাঁর লেখায় রবীন্দ্রনাথের ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ¦ী’ ব্যবহার করলেও তাঁর দুনিয়ায় সিডনির জায়গা হয়নি। যে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কথিত নিন্দায় এই লেখাটি ফেঁদেছেন সে হামলার নির্মম শিকার আমাদের সিডনি। এখনও হপ্তা পুরোয়নি। এখনও ব্যারিস্টার ক্যাবেরিনা, ম্যানেজার টরির রক্তের দাগ শুকোয়নি। তবু তাঁর মনে পড়েনি সিডনির কথা। এভাবেই তাঁর চিন্তা ও মননের সাম্প্রাদায়িক দেউলিয়াত্ব বেরিয়ে এসেছে। এখানেই আমাদের ভয়। দেশের বর্তমান সরকার ও সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন জঞ্জাল জঙ্গীবাদ দমনে বদ্ধপরিকর তখন এরা নানাভাবে ঝামেলা পাকাতে ব্যস্ত। পাকিদের দেশের রাজনীতি আমদানি করতে গিয়ে যারা নানাভাবে বিপদ ডেকে আনতে রাজি, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার বিকল্প নেই। এরা পাকিস্তানে শিশুহত্যার বিরুদ্ধে বলতে গিয়েও জঙ্গীবাদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারছে না। নিয়তি এদের কিভাবে মার্জনা করবে? বড়দিনের বড় উৎসবে প্রবাসী আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি দেশের খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের কথাও মনে রাখি আমরা। একদিন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সর্বধর্মের সমন্বয় আর সম্প্রীতির ভেতর পথ চলার প্রতিজ্ঞায়। আজ অনেক দূরে চলে এলেও একটু একটু করে সময় ঘুরছে আবার। মানুষের মনে জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতার বিপরীতে যে ঐক্য ও সম্ভাবনার আলো কেউ যেন তার ক্ষতি করতে না পারে।
×