ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র হক

ট্রিবিউট টু মোনাজাতউদ্দিন ॥ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, প্রিয়বন্ধু

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

ট্রিবিউট টু মোনাজাতউদ্দিন ॥ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, প্রিয়বন্ধু

বর্তমানের তরুণ সাংবাদিকদের অনেকেই মোনাজাতউদ্দিনের নাম শুনে থাকবেন হয়ত তাঁকে চিনবেন না। তিনি যে সাংবাদিকের জন্য কত বড় ‘ইনিস্টিটিউট’ ছিলেন বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিংয়ে, খবরের গভীর থেকে খবর খুঁড়ে আনার রিপোর্টিংয়ে তিনি আজও ‘আনপ্যারালাল’ হয়ে আছেন। যারা মোনাজাত ভাইকে খুব কাছে থেকে বুঝতে পারতেন, ভেতরের ভাবনা আয়ত্বে আনতে পারতেন (বর্তমানে কম্পিউটারের ভাষায় পড়তে পারতেন, মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে পড়া খুব কঠিন। যারা পারে তারা গুণীজনের কাছ থেকে অনেককিছ্ ুনিতে পারে) তারা তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তাকে ফলো করে বর্তমানেও এগিয়ে যেতে পরছেন। এভাবেও মোনাজাত ভাইকে তুলনা করা যায়। যার তুলনা তিনি নিজেই। ইনডেপথ রিপোর্টিং অর্থাৎ গভীর থেকে সংবাদ খুঁজে বের করে আনার সাংবাদিকতায় পুথিগত বিদ্যার বাইরে যা যা থাকা দরকার তার সবই ছিল মোনাজাত ভাইয়ের মধ্যে। তিনি মানুষের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেই তাকে পরিষ্কার জানতে পারতেন। তাঁর একটাই কথা, যেভাবেই হোক প্রকৃত খবর বের করে আনতে হবে। এজন্য যত কৌশল যত ডিপ্লোমেসি করা দরকার তা করতেই হবে। মোনাজাত ভাইয়ের লিখার সঙ্গে পরিচিত ৮০’র দশক থেকেই। তিনি যখন সংবাদে ছিলেন তখন তাঁর রিপোর্ট ফিচার পড়ে এতটাই এ্যাডিকটেট হয়ে গেলাম যে ওই নেশা আমাকেও পেয়ে বসল। ৮০’র দশকের মধ্যভাগে বগুড়ায় কাফেলা স্টুডিওতে তাঁর সঙ্গে দেখা। তাঁর সঙ্গে ক্যামেরা থাকত। এ্যানলগ যুগের সাদাকালো ফিল্মের ক্যামেরা। ৩৫ মিলিমিটার (এমএম) ফিল্মের ক্যামেরায় ছবি তোলা যায় ৩৬টি। ছবি তোলার পর ফিল্ম খুলে ডার্করুমে (অন্ধকার কক্ষ) নিয়ে গিয়ে প্রথমে ডেভেলপ (প্রসেস) তারপর ফিল্ম শুকিয়ে এনলার্জার মেশিনে প্রিন্ট। এ সবই করতে হয় ডার্করুমে। এর মধ্যে স্থানীয় একটি দৈনিকে কাজ করার সুবাদে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) আয়োজনে খুলনায় একটি ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেলাম। দীর্ঘ সময়ের এই ট্রেনিংয়ে সৌভাগ্য হলো দেশের মহীরুহু সাংবাদিকগণের কাছ থেকে হাতে করমে ট্রেনিংয় পাওয়ার। যেখানে ছিলেন বিচিত্রার দুর্জন উবাচখ্যাত সাংবাদিক খোন্দকার আলী আশরাফ, ইত্তেফাকের ওপেন সিক্রেট নামের স্কুপ রিপোর্টিংখ্যাত ও অভাজন নামে উপসম্পাদকীয় লেখক (এবং টিভি উপস্থাপক) সাংবাদিক আবেদ খান, পিআইবির ট্রেনিং ডিরেক্টর (লুপ্ত দৈনিক বাংলার সাংবাদিক) রফিকুল ইসলাম নাসিম (প্রয়াত) এবং সংবাদের তৎকালীন উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন। ওই ট্রেনিং শেষে পরীক্ষায় মাত্র এক মার্কের ব্যবধানে সংবাদের রুকুনউদ্দৌলা প্রথম স্থান ও আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। এক অনুষ্ঠানে আবেদ ভাই ও মোনাজাত ভাই আমার সামনে পিআইবির নাসিম ভাইকে বললেনÑ আমরা বোধ হয় পিটিয়ে পাটিয়ে সমুদ্রকে টেনে তুলেছি। তখন আমি ঢাকায় কয়েকটি ফিচার সার্ভিসে ফিচার লিখি। এর মধ্যে ডেভফিচার নামে ফিচার সংস্থা একটা কাজ দেয়। ইউনিসেফ রিলেটেড যত খরর প্রতিদিন দশটি কাগজে ছাপা হয় তা কেটে ক্লিপিংস করে বাংলা কাগজের রিপোর্ট সার সংক্ষেপ করে ইংরেজীতে লিখে দিতে হবে প্রতিদিন দশটার মধ্যে। এজন্য আমরা দু’জন কাজ করতাম। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ পাই ফিচার লেখার। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রদ্ধেয় তোয়াব খানের কল্যাণে দৈনিক জনকেণ্ঠ যোগদান। উনি ফোন করার সঙ্গেই আর কোন কিছু না তাকিয়ে সরাসরি চলে গিযেছিলাম তখনকার ৫৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার অফিসে। অফিসে যাওযার পথে কাঁকতালীয়ভাবে মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাচ্ছেন। যেই বলেছি জনকণ্ঠ অফিসে উনি একবারে ধমক দিয়ে বললেনÑ দেরি করছি কেন এক্ষুনি যান (মোনাজাত ভাই সকলকে আপনি সম্বোধন করতেন, পরে অবশ্য তুমি ডাকটি আদায় করে নিতে পেরেছি)। অন্য সময় মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই চা তো খেতেই হতো গল্পগুজবও করতে হতো। জনকণ্ঠে যোগদানের পর মোনাজাত ভাইয়ের ধারা নিজের মধ্যে চলে এলো। গ্রামে যাওয়া খবরের গভীরে থেকে সংগ্রহ। ১৯৯৪ সালের মধ্যভাগ। বগুড়ার কাহালু নন্দীগ্রাম অঞ্চলে একরাতে কয়েকশ’ তুঁতগাছ কেটে ফেলা হলো। বিষয়টি নিয়ে মেনাজাত ভাই হাসি-ঠাট্টা করছিলেন। মোনাজাত ভাইকে আমি পড়তে পারি। মাথায় ক্লিক করল তিনি কিছু করবেন। দৃষ্টি ফেরাতে তাঁর এই আচরণ। এর মধ্যেই তিনি কি কারণে রংপুর চলে গেলেন। দেরি না করে ওই এলাকায় গিয়ে যা দেখা ও বোঝা গেল তা হলো ভয়ঙ্কর। ওই দিনই ফ্যাক্সে (তখন ই মেইল চালু হয়নি) রিপোর্ট পাঠালাম। পরদিন গুরুত্বের সঙ্গে বগুড়ায় ফতোয়াবাজ রিপোর্ট ছাপা হলো। ওই দিনই মোনাজাত ভাই বগুড়া এসে প্রথমে একটা ধন্যবাদ দিয়ে বললেন ‘আপনি আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এমন রপ্ত করেছেন, যে ভয়টি করেছিলাম তাই হলো। এর আগেও তাই হয়েছে। আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কংগ্রাচুলেশন ফর গুড রিপোর্ট। ফলো আপ করতে থাকেন।’ এই হলো মোনাজাত ভাই। যিনি অন্যের প্রশংসা করতে জানেন এবং গাইড লাইন দেন। ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসে মোনাজাত ভাই সংবাদ ছেড়ে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগদান করে প্রথম যেদিন বগুড়া অফিসে এলেন তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ না করে আমার টেবিলের সামনে বসে প্রথম বললেন ‘আজ থেকে আমরা প্রতিবন্ধু নই মানুষের কল্যাণের যুদ্ধের মাঠে সৈনিক। যা করব জনকণ্ঠের জন্য মিলেমিশে করব।’ এরপর একসঙ্গে কাজ করার যে কি আনন্দ তা বুঝেছি। এক রাতে হঠাৎ মোনাজাত ভাই বাসায় এসে হাজির। রাত তখন দুইটা। বাইরে রেন্ট করা মাইক্রো বাস। বললেন, এক্ষুনি সিরাজগঞ্জ যেতে হবে। যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) সাইটে কি যেন হয়েছে সরকার বিষয়টি গোপন রাখছে। সয়েদাবাদে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গ-গোল হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট পরে সয়েদাবাদ যাওয়া যাবে না। লুঙ্গি ও পুরান কাপড় নিতে হবে। অনেক আগে গাড়ি রেখে হাঁটতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু। পরদিন রিপোর্ট। ব্যানার হেডিং। একটি স্কুপ রিপোর্টের সার্থকতায় কি যে আনন্দ তা বুঝিয়ে দিযেছেন মোনাজাত ভাই। বগুড়া এলে তিনি আমার বাড়িতে এসে অনেকটা সময় ধরে বিপোর্টের বিষয় ছাড়াও নানা বিষয় আলোচনা করেতন। বলতেন সমুদ্র আগামী দিনের সাংবাদিকতার পথ আরও কঠিন হয়ে যাবে। সব সময় ক্রিয়েটিভিটি এবং মৌলিক বিষয়গুলো মাথায় ধরে রাখবেন। আমাদের লেখালেখি করেই চলতে হবে। সততা, নিষ্ঠা, সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, ডিসিপ্লিন, ইমাজিনেশন চরিত্র এই বিষয়গুলোতে যেন কোনদিন দাগ না পড়ে। সৃষ্টিশীলতার প্রথম ধাপ ইমাজিনেশন। মৌলিকত্ব ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টিও হয় না। তিনি যে কত কথা বলতেন...। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্টিমার থেকে পড়ে গেলেন। যমুনা তাঁকে কেড়ে নিল। প্রায় ১৯ বছর হয়ে গেল। স্রোতের মতোই দিন চলে যায়। রেখে যায় কত কথা। আজ আমি একা। প্রতিবন্ধু নেই। মোনাজাত ভাই ১৯ বছর পর তোমাকে নিয়ে লিখছি। ট্রিবিউট জানাচ্ছি। আমি হেরে গিয়েছি তোমার কাছে অনেক আগে। আমার প্রিয় গানটি দিয়েই শেষ করি ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে আজ তুমি নেই তুমি আছো মন বলে তাই। তোমার অমর নাম জয় গৌরবে স্মরণে যে চিরদিন জানি লেখা রবে... তোমার জীবন যেন কাহিনীর মতো হে বিজয়ী বীর তুমি জয় তব ব্রত...। [email protected]
×