ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশত বার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

শিল্পাচার্য জয়নুল  আবেদিনের  জন্মশত  বার্ষিকী আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের রং-তুলির আঁচড়েই এদেশের চারুকলার যাত্রা শুরু। আপন মেধা ও সৃজনশীলতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত করেছেন বাংলার চিত্রকলার ভুবনকে। অনন্য সব শিল্প সৃষ্টি করে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি। আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের পথ দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। শুধু তাই নয়, বাংলার চারুশিল্প আন্দোলনেও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। আজ সোমবার কিংবদন্তি এই শিল্পীর শততম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী। প্রতি বছরই শিল্পাচার্যের জন্মদিন উপলক্ষে থাকে নানা আয়োজন। তবে এবার জন্মশতবর্ষ উদ্্যাপন উপলক্ষে বেড়েছে আনুষ্ঠানিকতার পরিসর। নেয়া হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে বছরব্যাপী কর্মসূচী। আজ বেলা ৩টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষের বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন। এরপর জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা জয়নুলের চিত্রিত ১০০ ছবি নিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রদর্শনী পরিদর্শন করবেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্র। এর আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জয়নুলের সমাধিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এ ছাড়া শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও শিল্পীদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা বর্ণিল আয়োজন। জয়নুল আবেদিনের গড়া প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আয়োজনে চলছে জয়নুল মেলা। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া চার দিনের মেলার শেষ দিন আজ সোমবার। আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে চারু ও কারুকলার রকমারি নিদর্শনে সাজানো হয়েছে মেলা। লোকজ আঙ্গিকে সজ্জিত মেলার সমাপনী দিনে সকাল থেকেই শুরু হবে কর্মসূচী। সকাল ১০টায় উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠানমালা। এরপর রয়েছে সম্মাননা প্রদান ও আলোচনা পর্ব। অনুষ্ঠানে চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনী ও শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। এদিনের আয়োজনে সঙ্গীত পরিবেশন করবে চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। বিকেলের আয়োজনে অংশ নেবেন চারুকলার সাবেকরা। স্মৃতির আয়নায় পেছনে ফিরে গিয়ে চলবে আলোচনা ও জমাট আড্ডা। এ পর্বের উপস্থাপনা করবেন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন। সন্ধ্যায় বসবে গানের আসর। গান শোনাবেন নাশিদ কামাল, কৃষ্ণকলিসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা। গাইবে চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড মেঘদল, বাউলা, তনুশ্রী ও মাস্টারব্যান্ড। গত মঙ্গলবার থেকে বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নকশী কাঁথার প্রদর্শনী। কাল রবিবার থেকে ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় শুরু হবে পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানমালা। বাংলাদেশে চারুকলা চর্চা ও আন্দোলনের পথের দিশারী বিরল প্রতিভার অধিকারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলায় জš§গ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ ও মা জয়নাবুন্নেছা। বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত, সুনিবিড় ও রূপময় প্রাকৃতিক পরিবেশে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রং-তুলির খেলায় ফুল-ফল, বৃক্ষ, লতাপাতা, মাছ, পাখিসহ নানা বিষয়কে মেলে ধরতেন ক্যানভাসে। আর এই ছবি আঁকার টানেই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন গবর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এখানেই চলে শিল্পাচার্যের চারুশিক্ষার দীক্ষা। ১৯৩৮ সালে ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম প্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রী। ততদিনে শিল্পী হিসেবেও শিল্পরসিকদের স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছেন। স্থান করে নেন মুষ্টিমেয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর তালিকায়। এরপর তিনি কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। এদেশের শিল্পের ভিত রচনায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জয়নুল আবেদিন। তাঁর হাত ধরেই বিকশিত হয় এদেশের চারুশিল্প মাধ্যম। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আধুনিক শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। আর শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এদেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাক্সক্ষায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। শিল্পীজীবনে রং-তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ১৯৬৯ সালে তাঁর ক্যানভাসে উঠে এসেছে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ১৯৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম নবান্ন। একই বছরে মনপুরা নামে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের হƒদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেছেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি। শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য এবং বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছিলেন। চিত্র ও শিল্পকলার মাধ্যমে আমাদের বাঙালী সংস্কৃতিকে তিনি বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছিলেন। ১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরবর্তীতে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। তাঁরা হলেন সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জয়নুল আবেদিন।
×