ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তর এক তরুণের পথচলা

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

একাত্তর এক তরুণের পথচলা

সময়টা ১৯৬৯। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। তরুণ আমি তখন দশম শ্রেণীতে। বাগেরহাট বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। পুলিশ কর্মকর্তা চাচার বাসায় থেকে পড়াশোনা করি। তাঁর কড়া নিষেধ আছে মিটিং মিছিলের ধারে কাছেও যেন না যাই। তখনকার মহকুমা শহরে আন্দোলন-কর্মসূচীর প্রাণকেন্দ্র ছিল বাগেরহাট পি.সি. কলেজ। সেখানকার ছাত্র নেতৃবৃন্দ স্কুলে স্কুলে গিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আহ্বান জানাতেন আন্দোলনে যোগ দিতে। চাচার নিষেধ মান্য করে বাসায় চলে আসাটাই ছিল প্রথম দিকে স্বাভাবিক। এরই মধ্যে একদিন নিজেকে যুক্ত করলাম সেøাগানরত মিছিলে। সেদিনের শহরটাকে মনে হচ্ছিল যেন প্রচ- শক্তি নিয়ে উত্তেজনায় কম্পমান। মিছিল যখন কলেজসংলগ্ন রাস্তায় তখনই শুরু হলো গুলি। এসডিও সাহেবের সরাসরি নেতৃত্বে মিছিলে আক্রমণ। ছত্রভঙ্গ হয়ে দেয়াল টপকে আত্মরক্ষায় সক্ষম হলাম। তার কিছুদিন পর আইয়ুব ভেসে গেল রাজদ- ইয়াহিয়ার হাতে দিয়ে। এলো ’৭০-এর নির্বাচন। আমি পটুয়াখালী সরকারী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। তারুণ্যের সবটুকু উচ্ছ্বাস আর শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম নৌকা প্রতীকে সমর্থন আদায়ের সংগ্রামে। নির্বাচনী ফলাফলে ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭, অন্যান্য ২। এ সময়ের এক নির্বাচনী সভার প্রবেশমুখে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখে বিস্মিত, মুগ্ধ হয়েছি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ। ভয়াল রাত। আগস্ট পর্যন্ত জীবনটা হাতে নিয়েই চলতে ফিরতে হয় পটুয়াখালী শহরে। কিন্তু আর বুঝি শেষ রক্ষা হয় না। বেছে বেছে তরুণ-যুবকদের পাকিস্তানী আর্মি তুলে নিয়ে যায়, পরে যাদের আর হদিস পাওয়া যায় না। শহরটা আর নিরাপদ নয়, গ্রামে চলে যাওয়াই নিরাপদ মনে করলাম। আতঙ্ক আর শঙ্কা মাথায় নিয়ে লঞ্চযোগে এসে নামলাম পিরোজপুরের হুলারহাট বন্দরে। সেখান থেকে শেয়ারের নৌকায় চার ঘণ্টার পথ আমার গ্রামের বাড়ি। ইতোমধ্যে জানলাম আমাদের পাশের গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্র মাত্র দু’দিন আগে এখানেই নিহত হয়েছেন তাঁর বন্ধুসহ। তাঁরা ঢাকা থেকে ফিরছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আমাদের নৌকা চলছে নদীর উজান বেয়ে। খানিকটা এগুতেই আট দশজনের এক রাজাকার দল হাঁক ছেড়ে মাঝিকে হুকুম দিল নৌকা ঘাটে ফিরিয়ে নিতে। যাত্রীরা সব প্রমাদ গুনলাম। কয়েকখানা বইসহ প্রিয় ডায়েরিখানা ব্যাগের তলায়। একবার ভাবলাম ফেলে দেই নদীর জলে। কিন্তু পারলাম না। অবশেষে নৌকার গলুইয়ের পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখলাম, আশা যদি পরে ফিরে পাওয়া যায়! এক পর্যায়ে হুলারহাটের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো আমাদের। একে একে জিজ্ঞাসাবাদ চলল দীর্ঘক্ষণ। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের দুঃসহ বন্দীদশা থেকে অবশেষে মুক্তি মিলল। আমি মুক্ত, বন্দী বাংলাদেশে। ইচ্ছেমতো কোথাও যাবার সাধ্যি নেই। শহরগুলো এক একটি মৃত্যুকূপ, ব্যতিক্রম নয় গ্রামগুলোও। মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে, কিন্তু দূরের সে পথ ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল। সকাল-সন্ধ্যায় রেডিও শুনি, গোপনে শুনি স্বাধীন বাংলা বেতার। এমআর আক্তার মুকুলের বিখ্যাত ব্যঙ্গ-রসাত্মক উদ্দীপনা সঞ্চারী কথিকা, শত্রু হননের খবর, উজ্জীবনের গান। শুনি দিল্লী থেকে প্রচারিত ইভা নাগের বাংলা খবর, আকাশবাণীর দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ পর্যালোচনা, সবই গোপনে কয়েকজন মিলে একত্রে জড়ো হয়ে। সময় এমন বৈরী হলো যে যুদ্ধে যেতে পথ পাই না আবার ঘরে থেকেও স্বস্তি পাই না। কয়েকদিন পর পরই রাজাকারদের তাড়া খেয়ে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ঠাঁই নিতে হয়, আবার সে গ্রামেও থাকা যায় না। একদিন মায়ের পা ছুয়ে তাঁর দোয়া নিয়ে ঘর ছাড়লাম। পথ অজানা, অচেনা। গন্তব্য ভারত অথবা অজানা দূরের মুক্তিবাহিনীর কোন ক্যাম্প। আমাকে হাজির করা হলো কমান্ডারের কাছে। তাঁর চেহারা দেখে আমার ভয় শঙ্কা কেটে গেল। দাঁড়ি, চুল, গোফে ঢাকা আত্মপ্রত্যয়ী এক মুখ। আমার দিকে সরাসরি না! আমি তোমার সালেক ভাই, মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার। আমি বললাম, ভারত যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়েছি। কমান্ডার বললেন, যেতে হবে না, আরো অনেকের সঙ্গে তোমারও ট্রেনিং হবে এখানে। পরদিন প্রত্যুষে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে রাইফেল হাতে মাঠে নামিয়ে দিলেন আরো জনাদশেকের সঙ্গে। চার্লস ডিকেন্স তাঁর উপন্যাসে আশা-হতাশা, থাকা-না থাকা নিয়ে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক যে করুণ ছবি এঁকেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে তা ভিন্ন আঙ্গিকে আমার মনে ভেসে উঠল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে, বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজ চত্বরে উদীয়মান লাল সূর্যের বিকীরণে it is the best of times, not the worst of times, it is the spring of hope, not the despair of winter, we have everything before us, nothing to loose except for life. লেখক : এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোট [email protected]
×