ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতে হিন্দু কট্টরপন্থীরা টার্গেট করছে সংখ্যালঘুদের

ধর্মান্তকরণে রাজনৈতিক অস্থিরতা

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ধর্মান্তকরণে রাজনৈতিক অস্থিরতা

ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তকরণ সে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ডেকে এনেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় কট্টরপন্থীরা তাদের ধর্মান্তকরণ ক্রিয়াকলাপের লক্ষ্য হিসেবে খ্রীস্টান ও মুসলিমদের বেছে নিয়েছে। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি করছে যে, মুসলিম ও খ্রীস্টানরা তাদের ধর্মে দীক্ষিত হতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দুদের বাধ্য করে এসেছে। কাজেই অহিন্দুদের বিশেষত বিদেশীদের অন্যদের ধর্মান্তরিত করার তৎপরতা খুবই সংবেদনশীল বিষয়। ভারতে ধর্মযাজকদের ভিসাদান কঠোরভাবে সীমিত রাখা হয়েছে এবং কোন কোন মিশনারিকে প্রকাশ্যে ধর্মান্তকরণ না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এখন এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় কট্টরপন্থী হিন্দু দলগুলো ওই ধর্মান্তকরণজনিত কারণে তাদের স্বধর্মীয়-হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পুষিয়ে আনার দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে অভিযান শুরু করেছে। চলতি মাসে আগ্রায় প্রায় ২০০ মুসলিমকে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি শাখা একযোগে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করে বলে খবর বেরোয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল আরএসএস ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) তাত্ত্বিক শাখা এবং এক সময় নরেন্দ্র আরএসএসেরই কর্মী ছিলেন। একই দলটি বড়দিনে হাজার হাজার খ্রীস্টানকে হিন্দুত্বে ধর্মান্তরিত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। সম্প্রতি ধর্মান্তরিত কিছু ব্যক্তি তাদের অর্থনৈতিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৌশলে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান। কিন্তু আরএসএস নেতা মোহন ভগবত ধর্মান্তকরণ কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প ব্যক্ত করেন। একে তাঁর দল ‘ঘরে ফেরা’ বলে অভিহিত করে থাকে। ভারতের ১২০ কোটি লোকের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ হিন্দু, কিন্তু শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ মুসলিম এবং অবশিষ্টদের বেশিরভাগ খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, আদিবাসী বা পার্শি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁর শাসননীতির অন্যতম মূল অংশে পরিণত করেন। কিন্তু ধর্মীয় সহিংসতা দেশটিকে বারবার নাড়া দিয়েছে এবং ধর্মীয় পরিচয় প্রায়ই ভোটদানের ধরণ নির্ধারণ করে। হিন্দু দলগুলো প্রায়ই ‘ভোট ব্যাংকের’ সমর্থন পেতে সংখ্যালঘুদের তোষণ করার দায়ে মধ্যপন্থী পার্টিগুলোকে অভিযুক্ত করে থাকে। পার্লামেন্টের সরকারবিরোধী সদস্যরা হিন্দু ধর্মান্তকরণকে বিভেদমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে নিন্দা জানান। তারা মোদি ধর্মান্তকরণের নিন্দা না করা পর্যন্ত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাকে অচল করে রাখতে ঐক্যবদ্ধ হন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক সিংভি এক সাক্ষাতকারে বলেন, এটি যে কারও জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু, কিন্তু এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকেই পার্লামেন্টে বিবৃতি দিতে হবে। পার্লামেন্ট অচল হয়ে পড়া সত্ত্বেও মোদি ধর্মান্তকরণের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানতে অস্বীকার করেছেন। এটি ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। মঙ্গলবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে শাসনের দিকে আবার দৃষ্টি দিতে হবে। বিজেপির মুখপাত্র নলিন কোহলি এক সাক্ষাতকারে উপহাস করে বলেন, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং খুব কমই প্রকাশ্যে কথা বলতেন। মোদি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের উদ্দেশে কখন, কোথায় এবং কী বলবেন, তা আমাদের তাঁকেই স্থির করতে দেয়া উচিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখর গুপ্ত বলেন, মোদি ধর্মান্তকরণের নিন্দা করতে এখনও পর্যন্ত অস্বীকার করে আসায় তিনি বিস্মিত। মোদির আইন প্রণয়নগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার এটি দৃশ্যত এক সহজ মূল্য। গুপ্ত বলেন, হয় এ সব ধর্মান্তকরণ থেকে এ সব লোককে বিরত রাখার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেই, অথবা তিনি তাদের মতোই চিন্তা করেন। কোনটি বেশি খারাপ তা আমি জানি না। মোদি নিজেও এক বিভাজক নেতা ছিলেন। যখন তিনি গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন ধর্মীয় দাঙ্গায় এক হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল মুসলিম। কোন কোন কট্টরপন্থী হিন্দু দল জোর দিয়ে বলছে, তারা মোদির নীরব সম্মতি নিয়েই এগুলো করছে। আরেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) এক মুখপাত্র সুরেন্দ্র জৈন এক সাক্ষাতকারে প্রশ্ন করেন, মোদি যে পুনঃধর্মান্তকরণ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন, তা আপনারা কিভাবে জানেন? তিনি বলেন, ‘এখানকার খ্রীস্টান ও মুসলিমরা আমাদের রক্তের ভাই। তাদের প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রতারণা করে ধর্মান্তকরণে বাধ্য করা হয়েছিল। যদি কেউ তাদের বংশধরদের ভুল সংশোধন করতে চায়, তাহলে তাতে দোষের কী আছে?’ রবিবার ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যের উপকূলে কোচি শহরের কাছে এক গ্রামে ছোট এক মন্দিরে ভিএইচপির এক শাখার আয়োজিত চার ঘণ্টার এক অনুষ্ঠানে প্রায় ৩০ খ্রীস্টানকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। কেরালার ভিএইচপির এক শীর্ষ নেতা ভি নারায়ণন ব্যাখ্যা করে বলেন, রাজ্যে ‘সেমাইটিক আব্রাহামিক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার’ কারণেই ধর্মান্তকরণের ঘটনাগুলো ঘটছে। তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেন, হিন্দুরা অনেক সমস্যার মধ্যে পড়েছে এবং আমরা তার সুরাহা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেরালার সাইরো মালাবার চার্চের মেজর আর্চ বিশপ কার্ডিন্যাল জর্জ এ্যালেনচেরি এক সাক্ষাতকারে বলেন, রাজ্যে ধর্মান্তকরণের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক এবং বিভেদমূলক। রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে এসেছে। তিনি প্রশ্ন করেন, তারা কেন এখন তা করছে, যা তারা এক বছর আগে করেনি? -ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস
×