ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রফতানির স্বার্থে সবুজ কর আদায়ে কৌশলী নীতি নিয়েছে সরকার

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

রফতানির স্বার্থে সবুজ কর আদায়ে কৌশলী নীতি নিয়েছে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রফতানি হ্রাসের আশঙ্কায় সবুজ কর আদায়ে কৌশলী নীতি গ্রহণ করছে সরকার। নীতিমালা তৈরির পর পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকাভুক্ত করা হলে ভবিষ্যতে রফতানি কার্যক্রমে অংশ নিতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় পরিবেশ দূষণকারী কারখানা হিসেবে চিহ্নিত না করে নতুন কোন কৌশলে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এনবিআরের সুপারিশে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এতে পরিবেশ সুরক্ষায় চলতি বাজেটে সবুজ কর বা গ্রীন ট্যাক্স আদায়ের ঘোষণা থাকলেও শুরুতেই সরকারের এ শুভ উদ্যোগটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, নিরাপদ, উন্নত কর্মপরিবেশ এবং মানদ- বজায় রেখে কারখানা পরিচালনায় সরকার ও অভ্যন্তরীণ উদ্যোক্তাদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ করছে এমন সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর বাড়তি করারোপের জন্য দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি দীর্ঘদিনের। এই বাস্তবতায় দূষণ নিরুৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ সুরক্ষা সারচার্জ গ্রীন ট্যাক্স আরোপ করা হয়। তাতে বলা হয় চলতি বছরের ৩০ জুন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও পণ্য নিশ্চিতে মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ (২২) ধারার (১) উপ-ধারা অনুসারে ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এনবিআর এই সারচার্জ আরোপ করতে গেলেই দেখা গেল যত বিপত্তি। কারণ দেশের রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ এনে রফতানিতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা চামড়া নিতে বিদেশী ক্রেতারা আপত্তি জানিয়েছেন। আগামী বছরের মার্চের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরিত না হলে অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এছাড়া দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। পরিবেশ অধিদফতর একাধিকবার অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছে। জানা গেছে, পরিবেশ অধিদফতর সারাদেশে পানি, বায়ু ও মাটি দূষণকারী ট্যানারি, গার্মেন্টস, ইটভাঁটি, চাল কল, রাসায়নিক কারখানা, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ ২ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানের নামের একটি তালিকা এনবিআরকে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রীন ট্যাক্স আদায় করা সম্ভব হলে সরকারের রাজস্ব খাতে আরও অতিরিক্ত ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা যোগ হতো বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রফতানি খাত বাধাগ্রস্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় নতুন কৌশলে গ্রীন ট্যাক্স আদায়ের কথা ভাবছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের তালিকার গেজেট এখনও প্রকাশ করতে পারেনি এনবিআর। কারণ মন্ত্রণালয় মনে করে এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। তাই অর্থ মন্ত্রণালয় পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থদ- হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে নির্দেশ দিয়েছে এনবিআরকে। একই মত এনবিআরেরও। সম্প্রতি এনবিআরে পাঠানো এক নির্দেশনামূলক চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, পরিবেশ দূষণের দায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন রফতানিমুখী শিল্প-প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা চালিয়ে নিতে চাপের মুখে রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে দূষণের দায়ে অভিযুক্ত আড়াই হাজার শিল্প-কারখানার নামের তালিকা নিয়ে গেজেট জারি করা হলে ভবিষ্যতে রফতানি কার্যক্রম আরও কঠিন হতে পারে। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হবে, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নয়। সূত্র মতে, দেশের পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত আড়াই হাজার শিল্প-কারখানার মধ্যে ১০৬৬টি ঢাকা বিভাগের। বাকিগুলো হলো- চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে। পরিবেশ দূষণকারী এসব কারখানার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, প্যাকেজিং ও প্রিন্টার্স, রাসায়নিক, ক্যাবলস, ওয়াশিং প্লান্ট এবং মেলামাইনের কারখানাও রয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডকইয়ার্ড ও রি- রোলিং মিলও রয়েছে। এতে শিল্প-কারখানাকে তিনটি ভাগ করে ঢাকাকে প্রথম ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। যেখানে রয়েছে ১ হাজার ২০০টি শিল্প-প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম ও খুলনাকে এ পরিবেশ দূষণকারী কারখানার তালিকায় দ্বিতীয় এবং বাকি বিভাগীয় ও বড় শহরগুলোকে তৃতীয় ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর বিধান অনুযায়ী ওই শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রীন ট্যাক্স হিসেবে সারচার্জ আদায়ে প্রাথমিক অবস্থায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বর্জ্য শোধানাগার নেই এমন কারখানা চিহ্নিত করা হয়। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে এনবিআরের আয়কর বিভাগের সদ্য বিদায়ী সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার একটি ভাল উদ্যোগ থেকে গ্রীন ট্যাক্স আদায়ের ঘোষণা দেয়। এটি করা গেলে পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। কিন্তু যেসব কারখানা দূষণের দায়ে অভিযুক্ত তারা আবার রফতানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নিরাপদ ও উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টির জন্য ক্রেতারা এখন বাংলাদেশকে চাপের মুখে রাখছে। এই বাস্তবতায় সরকার কিছুটা কৌশলী নীতি গ্রহণ করেছে। তবে পর্যায়ক্রমে সব প্রতিষ্ঠানই দূষণমুক্ত হতে হবে। এদিকে দীর্ঘদিন থেকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, টঙ্গী খাল, বালু নদী, শীতলক্ষ্যাসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি বর্জ্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দূষণ ও বর্জ্যরে কারণে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সরকার চলতি অর্থবছর থেকে দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দূষণ রোধ ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) চালু উৎসাহিত করতে এই করারোপ করেছিল। এদিকে এনবিআরের করা নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করছে, তাদের কাছে থেকে এই নতুন কর আদায় করা হবে। পরিবেশ অধিদফতরে নিবন্ধন করা যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করে, তাদের ওপর মূল্যভিত্তিক ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আদায় করার কথা রয়েছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) পরিশোধ করে। তবে এবার প্রদেয় মূল্য সংযোজন করের সঙ্গে অতিরিক্ত ১ শতাংশ সারচার্জ আদায় করার ঘোষণা রয়েছে।
×