ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হযরত মরিয়ম ‘আলায়হাস্ সালাম’

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

হযরত মরিয়ম ‘আলায়হাস্ সালাম’

হযরত ঈসা ‘আলায়হিস্ সালামের আম্মাজান হচ্ছেন হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালাম। ভাষাভেদে এই মরিয়াম নামটির বিভিন্ন উচ্চারণ রয়েছে। যেমন : আরবীতে র্মইয়াম, হিব্রুতে মারিয়া, লাতিন ও ইংরেজীতে মেরী। কুরআন মজীদের ১৯ নম্বর সূরার নাম মারইয়াম। সূরা মারইয়ামের ১৬ নম্বর আয়াতে কারীমা থেকে ৩৫ নম্বর আয়াতে কারীমা পর্যন্ত হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম প্রসঙ্গ এবং তাঁর আব্বা আম্মা উভয়েই যে বনী ইসরাইল বংশোদ্ভূত তা রয়েছে। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালামের আব্বার নাম ইমরান, আম্মার নাম হান্না এবং নানাজানের নাম ফাকুম। ইমরান ও হান্না অতিশয় বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তখনও তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন তাঁরা একটি পাখিকে দেখতে পেলেন যে পাখিটি তাঁর ছানাকে ঠোঁট দিয়ে খাওয়াচ্ছে। তখন তাঁদের অন্তরে সন্তান লাভের আকাক্সক্ষা প্রবল হয়ে উঠল। তাঁরা আল্লাহ্্র দরবারে একটি সন্তানের জন্য দু’আ কবুল করলেন। দেখা গেল কিছুদিনের মধ্যেই ইমরানের স্ত্রী হান্না গর্ভবতী হয়ে গেছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ওকে বায়তুল মুকাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করবেন। তাঁরা এই মানতকালে ভাবেনি যে, যদি কন্যাসন্তান হয় তাহলে তো এই কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। কেননা স্ত্রীলোক বা কন্যাসন্তানকে মসজিদের খাদিমা নিয়োজিত করার কোন ধর্মীয় বিধান নেই। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল : হে আমার রব, আমি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি। সে যা প্রসব করেছে আল্লাহ্ তা সম্যক অবগত। আর ছেলে তো এই মেয়ের মতো নয়, আমি ওর নাম রেখেছি র্ম্ইায়াম। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৩৫-৩৬)। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বেই পিতৃহারা হন। শিশু মরিয়ামের লালন-পালনের দায়িত্বভার নেবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তাঁর খালু হযরত যাকারিয়া ‘আলায়হিস্্ সালাম। কিন্তু ইয়াহুদী যাজকরা জোর আপত্তি জানায়। এছাড়াও অনেকেই তাঁর অভিভাবক হবার জন্য দাবি উত্থাপন করে। তখন যাজকগণ সিদ্ধান্ত দেয় এই অভিভাকত্ব নির্ধারণের জন্য লটারী করা হোক, নদীতে কলম নিক্ষেপ করা হোক। যার কলম ভেসে উঠবে সেই মরিয়ামের অভিভাবকত্ব লাভ করবে। আগ্রহী সবাই কলম ছুড়লো, কিন্তু দেখা গেল বৃদ্ধ যাকারিয়া ‘আলায়হিস সালামের কলমই ভেসে উঠেছে। ফলে যাকারিয়া ‘আলায়হিস সালামই অভিভাবক সাব্যস্ত হলেন। মরিয়মের আপন খালু হযরত যাকারিয়া ‘আলায়হিস্ সালাম-তিনিও নবী ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালামের আম্মার আপন বোন ইশ্বার স্বামী ছিলেন হযরত যাকারিয়া ‘আলায়হিস সালাম। কুরআন মজীদে হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস সালামের অভিভাবক নির্ধারণের জন্য কলম নিক্ষেপের ঘটনা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তা অদৃশ্যের সংবাদ যা তোমাকে প্রত্যাদেশ দ্বারা অবহিত করছি। মারইয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে সে জন্য তাঁরা তাঁদের কলম নিক্ষেপ করেছিল, তুমি তখন তাঁদের কাছে ছিলে না এবং তাঁরা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনও তুমি তাঁদের নিকট ছিলে না। (সূরা আল ইমরান : ৪৪)। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্্ সালামের আম্মাজান হান্না মানত করেছিলেন যে, তাঁর সন্তান হলে মসজিদের খাদিমা করবেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে মসজিদের একটি প্রকোষ্ঠে (মিহ্ অথবা হুজ্য়) রাখা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধান করতে থাকেন হযরত যাকারিয়া ‘আলায়হিস্ সালাম। যদিও যাকারিয়া ‘আলায়হিস্ সালাম অভিভাবক হয়েছিলেন কিন্তু তিনি এমন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন যে, সর্বক্ষণ তাকে দেখাশোনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না, যে কারণে তিনি তাঁর কন্যাকে অর্থাৎ হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালামের খালাত বোনকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ভার দেন। মাঝে মধ্যে তিনি যখন মরিয়াম আলায়হিস্ সালামকে দেখতে আসতেন তখনই দেখতে পেতেন যে, হুজরাতে মরিয়ামের জন্য টাটকা ফলফলারি ও পানীয় রয়েছে, তা দেখে তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়তেন। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর তাঁর রব তাঁকে ভালভাবে কবুল করলেন এবং তাঁকে উত্তমরূপে লালন পালন করলেন এবং তিনি তাঁকে যাকায়িার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই জাকরিয়া প্রকোষ্ঠে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে যেতেন তখনই তাঁর নিকট খাদ্যসামগ্রী দেখতে পেতেন। তিনি বলতেন : ইয়া মারইয়ামু আন্নালাকি হাযা- এসব তুমি কোথায় পেলে? তিনি বলতেন : হুয়া মিন্ ইনদিল্লাহ- এসব আল্লাহর নিকট থেকে। এভাবে এই প্রকোষ্ঠে হযরত মরিয়াম আলায়হাস সালাম বালিগা হয়ে উঠলেন। মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ঋতুকালীন সময়ে তিনি গৃহে আসতেন। হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্্ সালাম হযরত মরিয়াম আলায়হাস সালামের জন্য মসজিদ সংলগ্ন একটি কামরা তৈরি করে দেন। জানা যায় যে, তিনি কাঠের মিস্ত্রির পেশা গ্রহণ করেছিলেন জীবিকার তাগিদে। এটাও জানা যায় যে, হযরত মরিয়াম আলায়হিস্ সালাম এই কামরায় সারাক্ষণ আল্লাহর ইবাদত করার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতেন এবং রাতের বেলায় তাঁর খালা ইশাবা অর্থাৎ হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্্ সালামের স্ত্রীর কাছে গিয়ে ঘুমোতেন। হযরত মরিয়ম আলায়হাস্ সালামের ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, তাঁর তাকওয়া ও যুহদ তথা জগতসংসারের প্রতি অনাসক্তির কথা জেরুজালেমের অধিবাসীদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। তিনি আবিদা ও যাহিদা হিসেবে মশহুর হয়ে যান। ফেরেশ্তাগণ তাঁকে জানিয়ে যান যে, ইয়া মারইয়ামু ইন্নাল্লাহাসতফাকি ওয়া তহহারাকি ওয়াসতফাকি ‘আলা নিসায়িল্ আলামীন। ইয়া মারইয়ামুক্নুতী লি রব্বিকি ওয়াসজুদী ওয়ারকা’ঈন মা’আর রকি’ঈন-হে মারইয়াম- আল্লাহু, আপনাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং আপনাকে বিশ্বজগতের নারীগণের মধ্যে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম, আপনি আপনার রবের অনুগত হোন ও সিজদা করুন এবং যাঁরা রুকু করে তাঁদের সাথে রুকু করুন। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৪২-৪৩)। বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্বদিকে পর্দা দিয়ে ঘেরা একটি নিরালা স্থানে হযরত মরিয়াম আলায়হাস্্ সালাম গোসলাদি করতেন। জানা যায় যে, এই কারণে খ্রীস্টানরা পূর্বদিকে মুখ করে উপাসনা করে। সে যাক, একদিন ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আলায়হিস্্ সালাম আল্লাহর নির্দেশে তাঁর সম্মুখে পূর্ণ মানবের সুরতে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে একটি পুত্র সন্তানের সুংবাদ দান করলেন। কুমারী হযরত মরিয়াম আলায়হাস্্ সালাম এ কথা শুনে যে উত্তর দিয়েছিলেন তা কুরআন মজীদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : মারইয়াম বললেন, কেমন করে আমার পুত্র হবে, কেননা আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। সে (জিবরাইল) বললো, এমনিতেই হবে, তোমার রব (আল্লাহ) বলেছেন, হুয়া আলায়ইয়া হায়য়িনু, ওয়া লিনাজ্জ্ আলাহু আয়তাল্ লিননাসি ওয়া রহমাতামমিন্না, ওয়া কানা আম্রাম মাকদীইয়া- এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এই জন্য সৃষ্টি করবো যাতে সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট থেকে এক অনুগ্রহ, আর এটা তো এক স্থিরকৃত ব্যাপার। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২০-২২)। সূরা আল ইমরানে আরও বিস্তারিতভাবে এই বৃত্তান্ত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ফেরেশতারা বললো, হে মারইয়াম, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটা কলেমার সুংসবাদ দিয়েছেন। তাঁর নাম মসীহ্্ ঈসা ইবনে মারইয়াম, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত হবে এবং সে সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্যতম হবে। সে দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে এবং সে হবে পুণ্যবানদের একজন। তিনি (মরিয়াম) বললেন : হে আমার রব, আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি, আমার সন্তান হবে কিভাবে? তিনি (আল্লাহ) বললেন, এমনিতেই, তিনি যখন কোনো কিছু স্থির করেন তখন বলেন হও (কুন) তখন তা হয়ে যায় এবং তিনি (আল্লাহ) তাকে শিক্ষা দেবেন কিতাব, হিকমত, তওরাত ও ইঞ্জিল এবং তাকে বনী ইসরাইলীদের জন্য রসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্য কাদা দিয়ে একটি পাখীর মতো আকৃতি গঠন করবো, অতঃপর আমি তাতে ফুঁ দেবো, ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তদের নিরাময় করবো এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করবো। (সূরা আল ইমান : আয়াত ৪৫-৪৯)। ইতোমধ্যে হযরত মরিয়ম আলায়হাস সালাম গর্ভবতী হলেন, এটা আল্লাহর এক অনন্য কুদরতের নিদর্শন। যে নিদর্শন আমরা লক্ষ্য করি হযরত আদম আলায়হিস্্ সালামের বিনা মাতা-পিতায় সৃষ্টি হওয়াতে। হযরত মরিয়ম আলায়হাস্ সালামে প্রসব বেদনা উঠলে তিনি দ্রুত একটা খেজুর গাছের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। ১৬ বছর বয়স্ক মরিয়াম আলায়হাস্ সালামে প্রসব বেদনায় দারুণ কাতর হয়ে বলতে লাগলেন : হায়! এর পূর্বে যদি আমি মরে যেতাম ও লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৩)। অদৃশ্য থেকে কে যেনো তাঁকে আহ্বান করে বললো : তুমি দুঃখ করো না, তোমার পাদদেশে তোমার রব এক নহর সৃষ্টি করেছেন, তুমি তোমার দিককার খেজুর বৃক্ষের কা-খানি নাড়া দাও, তা তোমাকে সুপক্ক তাজা খেজুর দেবে। সুতরাং খাও, পান করো ও চক্ষু জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকে দেখলে বলবে : আমি দয়াময়ের উদ্দেশে মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৩-২৬)। আরও জানা যায় যে, তিনি ৪০ দিন একটি পর্বত গুহায় অবস্থান করেছিলেন। ৪০ দিন পর শিশু ঈসাকে নিয়ে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে এলে তাঁরা তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলো। তাঁরা বলতে লাগল : তোমার আব্বা তো অসৎ লোক ছিলেন না এবং তোমার আম্মাও তো ব্যভিচারিণী ছিলেন না। তখন মরিয়ম (আ.) শিশুর দিকে ইশারা করলেন। লোকজন বললো, কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবো। তখন নবজাতক শিশু ঈসা বললেন : আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কোন তিনি আমাকে প্রাচুর্যম-িত করেছেন। আমি যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৯-৩২)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইয়াহুদীদের যে সমস্ত কারণে অভিশপ্ত করেছেন তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালামের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া ও তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তারা (ইয়াহুদীরা) লানতগ্রস্ত হয়েছে তাদের কুফরীর জন্য এবং মারইয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্য। (সুরা নিসা : আয়াত ১৫৬)। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম হযরত ঈসা ‘আলায়হিস্্ সালামের আম্মা। জানা যায়, শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্ম মুহূর্তে আসমান থেকে মা আমিনার পরিচর্যার জন্য যে ক’জন হুর ও রমণী ছিলেন তাঁদের মধ্যে আসিয়া ও মরিয়ামও ছিলেন। মীলাদ শরীফে যে তাওয়াল্লুদ পড়া হয় তাতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ
×