ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনের আশপাশের শত শত বিঘা জমি কিনছে প্রভাবশালীরা

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের আশপাশের শত শত বিঘা জমি কিনছে প্রভাবশালীরা

রশিদ মামুন/ আহসান হাবিব হাসান, সুন্দরবন থেকে ॥ ব্যাপক শিল্পায়নের জন্য সুন্দরবনের ২৫০ মিটারের পাশ থেকেই শত শত বিঘা জমি কিনছেন প্রভাবশালীরা। সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে দেশের প্রসিদ্ধ শিল্প গ্রুপ থেকে শুরু করে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসব জমি কিনে ফেলছে। ডকইয়ার্ড, জাহাজভাঙ্গা শিল্প ছাড়াও ব্যাপকভাবে শিল্পায়নের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সংরক্ষিত এই বনের এত কাছের জমি কেনা হচ্ছে। সুন্দরবনের ৩০০ মিটারের মধ্যে ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে এই এলাকার মানুষ। বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদফতরের নাকের ডগায় দিনের পর দিন সংরক্ষিত বনের এত কাছে শত শত একর জমির হাত বদল হলেও সকলেই রহস্যজনক নীরব ভূমিকায় রয়েছেন। জানতে চাইলে মংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের কাছে জমি কেনার জন্য দুই ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিয়েছে। অন্য জমি ক্রয়ের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। সুন্দরবনের মাত্র ৩০০ মিটারের মধ্যে এভাবে শত শত বিঘা জমির হাত বদলের বিষয়টি সরকারের ওপর মহলকে তিনি জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, আমার জানা না থাকায় জানাতে পারেনি। তিনি জানান ৬০ বিঘার অতিরিক্ত জমি কিনতে হলে অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্প-কারখানা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানান তিনি। বৃহস্পতিবার সুন্দরবন সংলগ্ন চিলা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে স্থানীয়দের অনেকেই বসত ভিটা রেখে সব জমি বিক্রি করে দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু বাসিন্দারা বেশি জমি বিক্রি করেছে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ ভারত চলে গেছেন। অন্যরাও এলাকা ছেড়ে খুলনার দাকোপ চলে যাচ্ছেন। যদিও মুসলমানরাও কেউ কেউ তাদের জমি বিক্রি করে দিয়েছে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যারা জমি কিনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে, এনার্জিপ্যাক ৪৪ একর, এনার্জি লিমিটেড ১১৫ একর, সানমেরিন ৭০ থেকে ৭৫ একর, লিথি গ্রুপ ৬০ থেকে ৭০ একর, ফোমকম গ্রুপ ৪০ থেকে ৪৫ একর, ইনডেক্স পাওয়ার ১৮ একর, নিক্সন গ্রুপ ১০৩ একর, তৌহিদ কামাল গ্রুপ (টিকে) ১১৮ একর, সুন্দরবন শিপইয়ার্ড ৩২ একর, নাভানা গ্রুপ ৩২ একর, করিম গ্রুপ ৪০ একর, ডেকান ৪৫ একর, কার্বন হোল্ডিং ১৮ একর। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানায় অনেকেই জমি কিনছেন। সঙ্কটাপন্ন এলাকায়। বৃহস্পতিবার জয়মনির এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে জমির ওপর এসব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এখন থেকে সাত আট বছর আগে তাদের জমির দাম ছিল বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন সাত থেকে ১২ লাখ টাকায় প্রতিবিঘা জমি বিক্রি হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া জমিও কিনে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। স্থানীয়রা জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড হ্যাঙ্গেল সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী এবং বরগুনার বিস্তৃীর্ণ এলাকার বন কেটে জনবসতি গড়ে দেন। এখন পশুর নদীর পশ্চিমপাড়ে ঢাংমারি এবং পূর্বপাড়ে জয়মনি থেকে শুরু হয়ে সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশেছে। জয়মনির পর আর কোন লোকালয় নেই। কিন্তু এখন এভাবে সুন্দরবন ঘেঁষে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে এই এলাকারও বন উজাড় হয়ে যাবে। আশির দশকে সুন্দরবনের আশপাশে চিংড়ি ঘেরের কুফল এখন এসে বুঝতে পারছে সরকার। এভাবে এখন শিল্প কারখানার অনুমোদন দিলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে সুন্দরবনের ওপর। জয়মনি গোলা গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ গাইন বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি বসতভিটাটুকু রেখে সব জমিই ফোমকমের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এভাবে চিলা ইউনিয়নের ৭, ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৩০০ হিন্দু ভোটারের মধ্যে যাদের জমি ছিল তারা বসতভিটা রেখে সব জমিই বিক্রি করে দিয়েছে। দাম বেশি পাওয়ার কারণেই স্থানীয়রা জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি। অনেকেই জমি বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম জানান, এই এলাকায় সাধারণ মানুষের বেশিরভাগ জমিই কিনে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এই জমিতে কি হবে না হবে তা কেউ জানেন না। জমি কেনার জন্য স্থানীয় একটি দালাল চক্র রয়েছে। তাদের মাধ্যমেই এরা ঢাকায় বসে জমি কিনে থাকেন। তবে শুনছি এসব জায়গায় শিল্প-কারখানা করা হবে। অপর বাসিন্দা মাহাতাব আলী শেখ জানান, এই এলাকার প্রায় সব জমিই বিক্রি হয়েছে। এখন বসতভিটা ছাড়া আর কোন জমি নেই। কেউ কেউ বসতভিটাও বিক্রি করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করছে বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুন্দরবনের এত কাছে শিল্প প্রতিষ্ঠান হলে এর জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। গোটা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ রামসার কনভেনশন অনুযায়ী সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিকভাবে আরও দায়িত্বশীল করে। সেক্ষেত্রে এত কাছে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি এখনই দেখা উচিত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। রামপালে প্রস্তাবিত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ বিদ্যুত কেন্দ্রের দূরত্ব সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিকভাবে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন শিল্প-কারখানা স্থাপন না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেজন্যই আরও চার কিলোমিটার দূরে এই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সুন্দরবনের পাশে হলেও এসব জমি ব্যক্তি মালিকানার। সঙ্গত কারণে এখানে জমি কেনা-বেচার বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। সরকারের উপর পর্যায়ে এ বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলেও তার জানা নেই বলে জানান তিনি। সুন্দরবন সংলগ্ন চিলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কোন কোন জমি বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। এসব এলাকায় এলপিজি প্লান্ট নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে কোন কোন কোম্পানি। সরকার এলপিজির ব্যাপক সম্প্রসারণে যেসব কোম্পানিকে কাজ দিয়েছে তারাই বেশিরভাগ এই এলাকায় জমি কিনেছে। আশঙ্কা রয়েছে সুন্দরবনের পাশে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন হলে বড় বড় জাহাজ আসবে। বেশিরভাগ জাহাজই সুন্দরবনের ওপর দিয়ে এসব শিল্প-কারখানায় আসতে হবে। চলাচলকারী যান্ত্রিক নৌযান ও জাহাজগুলো হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো, তেলসহ দূষিত বর্জ্য পানিতে ফেলায় নদীর ডলফিন এবং বনের বাঘ ও হরিণসহ এখানকার জলজ ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে রয়েছে। ক্রমাগত নদীর পানি দূষিত হলে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ জন্মের হারও কমে যাবে, যা এ এলাকার প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। জানতে চাইলে খুলনার পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে, জমি হস্তান্তরের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে সুন্দরবনের কাছে কেউ শিল্প-কারখানা করতে চাইলে তাদের পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। কেউ অনুমোদন চাইলে আমরা বিষয়গুলো দেখব বলে জানান তিনি।
×