ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশহারা বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

দেশহারা বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ

বড় মানুষের সঙ্গে অল্প পরিচয় থাকলে কখনও কখনও একটি জটিল মানসিক সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের মতো মানুষদের। তাঁদের নিয়ে কখনও কখনও দু’কলম লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন যেন হয়ে ওঠে না। সব থেকে বড় বাধা আসে নিজ যোগ্যতার কথা চিন্তা করে। মনে হয়, যদি লেখার ভেতর দিয়ে মানুষটাকে প্রকাশ করতে না পারি। যেমন আই কে গুজরাল মারা গেলে সেদিন রাতেই তাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। ছোট ছোট সামান্য কিছু স্মৃতি, তাঁর লেখা, আত্মজীবনী সব মিলিয়ে মনে করলাম একটা কিছু লিখি। কিছুটা লিখে মনে হয়েছিল ঠিক হচ্ছে না, পরে লিখি। ওই সময়ে সেভেন সিস্টার পোস্টের এডিটরের সঙ্গে কথা হয়, উনি বলেন, দাদা, আমার জন্য কিছু লেখেন গুজরালকে নিয়ে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাহলে শুধু সেভেন সিস্টার পোস্টেই লিখি। তারপরে সেভেন সিস্টার পোস্টে অনেক লেখা লিখেছি। কিন্তু ওই লেখা আর হয়নি। যতবার চেষ্টা করেছি, ততবার কেন যেন মনে হয়েছিল লেখাটি ঠিক গুজরালকে প্রকাশ করতে পারেনি। তপন রায় চৌধুরি মারা যাওয়ার পরে মনে হচ্ছে ঠিক একই সমস্যায় পড়েছি। এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেল কিন্তু ঠিক তাঁকে নিয়ে লিখতে পারছি না। তপন রায় চৌধুরি শুধু বাংলাদেশের মানুষ বলে নন, তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী বাঙালনামার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। তপন রায় চৌধুরির কথা শুরু করার আগে গুজরালের কথা উল্লেখ করার ভেতর যোগসূত্র এ নয় যে, এই দু’জনকে নিয়েই লেখা হয়নি। এ দু’জনের ভেতর যোগসূত্র হলো, দু’জনেই জন্মভূমি হারা। একজন তাঁর জন্মস্থান লাহোরের সেই ছোট্ট গ্রামটি হারিয়ে, আরেকজন বরিশালের নদীঘেরা একটি গ্রাম হারিয়ে ভারতের অপরাংশের নাগরিক হন। গুজরাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তপন রায় চৌধুরি বিশ্বখ্যাত শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ হয়েছিলেন। তপন রায় চৌধুরির সঙ্গে শেষ আলাপ হয় ২০০৯ অথবা ২০১০ সালে। সেদিনও মনে হয়েছিল, না, তিনি কোন মাতৃভূমি খুঁজে পাননি। গুজরাল মারা যাওয়ার পরেও তাঁর আত্মজীবনীর ওই অংশটি বেশ কয়েকবার পড়েছি, যেখানে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে যখন পাকিস্তানে তাঁর নিজ গ্রামটি দেখতে যান তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। খুবই সহজ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এরপরেও তাঁর ভাষা বলে দেয়, ভারতের ওই প্রধানমন্ত্রী তাঁর মাতৃভূমি খুঁজে পাননি। ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরিকে নিয়ে তাঁর ছাত্র গওহর রিজভী যদি কখনও কোন লেখা লেখেন তিনিই প্রকৃত লেখাটি লিখতে পারবেন। ইতিহাসের বারান্দা না মাড়ানো আমাদের মতো মানুষের পক্ষে ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরির কাজ নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। কারণ ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরির কাজের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৮৪ বা ’৮৫ সালের দিকে। ইন্ডিয়ান হাইকমিশন পরিচালিত লাইব্রেরীর নতুন বইয়ের ভেতর দেখতে পাই ইরফান হাবিবের সঙ্গে ভারতের অর্থনীতির ইতিহাস সম্পাদনা করেছেন তপন রায় চৌধুরি নামক এক বাঙালী। তখন তো ইন্টারনেটের বা গুগলের যুগ নয়, তাই বেশ কষ্ট করে তাঁর সম্পর্কে জানতে হয়। মনে মনে খুব লজ্জিত হই, ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপর, বিপান চন্দ প্রমুখ সেক্যুলার ও বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাসবিদদের সম্পর্কে কিছু না জানলেও তাঁদের নামটি জানি অথচ একই ধারার এত বড় ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরি সম্পর্কে জানা নেই। ইন্ডিয়ান অর্থনীতির ইতিহাসে তপন রায় চৌধুরির লেখাগুলোর বিষয় যে কাউকে টানবে, বিশেষ করে মোগল আমলের অর্থনীতির ইতিহাস। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ব্যবসা, মোগল আমলে অকৃষিপণ্য প্রভৃতি লেখা। মোগলরা ভারতকে কিছু না দিলেও অন্তত একটি একক ভারত তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে গেছে বলেই হয়ত মোগলদের প্রতি একটা আকর্ষণ সকলের। অবশ্য মোগল সম্রাট বাবুরই যে একক ভারত তৈরির রূপকার এ কথা অনেকে স্বীকার করবেন না। সে ক্ষেত্রে চিন্তাটি একটু ভিন্ন। কারণ, মোগলরা অস্ত্র দ্বারা, প্রশাসনিক কাঠামো দ্বারা একক ভারত তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে তার আগে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে সমাজ-আত্মার মিল তৈরি করে একটি একক ভারত তৈরির কাজ হয় এই উপমহাদেশে। যে আত্মাটি এখনও বর্তমান। যা হোক, পরে জেনেছি তপন রায় চৌধুরির এই মোগলের প্রতি ভালোবাসার মূল কারণ, তাঁর শিক্ষক স্যার যদুনাথ সরকার। শিক্ষক যদুনাথ সরকারের সঙ্গে বিখ্যাত ইতিহাসের গবেষণার কাজ ‘দ্য ফল অব মোগল এমপায়ার’ রচনার সময় অনেক কাজ করেন তপন রায় চৌধুরি। তাঁর ভাষায় তিনি শুধু প্রুফ দেখেছেন। নিজেকে নিয়ে এভাবে হালকা রসিকতা করার তপন রায় চৌধুরির যে তুখোড় ক্ষমতা ছিল তা তাঁর সঙ্গে যারা দু’একটা আড্ডায় বসেছেন তাঁরা সকলে জানেন। তপন রায় চৌধুরি শেষ ঢাকায় এসেছিলেন সম্ভবত ২০০৯ কি ২০১০ সালে। চলে যাওয়ার আগের দিন রাতেও অনেক সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। বাস্তবে ওই আড্ডাটিতে কোনমতেই আমাকে ঢোকানো যায় না। কারণ, নূরজাহান বোসের বাসায় ওই আড্ডাটি ছিল, তপন রায় চৌধুরির সহপাঠীদের একটি মিলনমেলা। তাঁর সহপাঠী ঐতিহাসিক জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ ছিলেন। তাদের ভেতর নূরজাহান বোস আমাকে কেন হংস মাঝে বক যথা হিসেবে উপস্থিত রেখেছিলেন ঠিক জানি না। সেখানে বসে কথা-বার্তার একপর্যায়ে জানতে পারি, তপন রায় চৌধুরি তখনও অপেক্ষা করছেন একটি ফোন কলের জন্যে। কারণ, তিনি ঢাকায় আসার পরেই ওই ভদ্রলোকের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা এ্যাপয়েনমেন্ট করে দিতে বলেছেন। ভদ্রলোকও তখন প্রধানমন্ত্রীর খুবই কাছের। কিন্তু এক সপ্তাহের মতো হয়ে গেছে তিনি সে কাজটি করেননি। বৌদির কাছে জানতে পারলাম পরদিন বিকেলে তাদের ফ্লাইট। অন্তত সকালেও শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয় কিনা এ জন্য তপন রায় চৌধুরি ফোন কলটির জন্য অপেক্ষা করছেন। পরে কথাবার্তায় বুঝতে পারি তপন রায় চৌধুরির ইচ্ছে ছিল একজন ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি বর্তমান বিশ্বের যে পরিবর্তন দেখছেন, সে সময়ে শেখ হাসিনার মৌলবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীর বিচারসহ কিছু বিষয়ে তাঁর চিন্তা শেয়ার করা। তপন রায় চৌধুরি সেদিন ওই চিন্তা শেয়ার করতে পারলে বাংলাদেশের লাভ হতো কিনা সে কথা ভিন্ন। তবে হতেও তো পারত। কারণ, তপন রায় চৌধুরি যখন অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা করতে যান তখন ভারতের ইতিহাস বলতে ওয়ারেন হেসটিং অবধি পড়ানো হতো। তপন রায় চৌধুরির প্রচেষ্টায় অক্সফোর্ড গান্ধীর মুভমেন্ট পর্যন্ত তাদের সিলেবাসে আনে এবং সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস। বাংলাদেশেরও প্রয়োজন, এদেশের প্রকৃত ইতিহাস বিশ্বখ্যাত ইউনিভার্সিটিগুলোর সিলেবাসে আসুক। তাহলে আজ দেশে ইতিহাস নিয়ে যে নিম্নমানের আচরণ চলছে এগুলো ভবিষ্যতে কোন কালো দাগ ইতিহাসের ওপর রাখতে পারবে না। যা হোক, দেশহারা বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরি পারেননি তাঁর প্রিয় জন্মভূমির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে অথচ কত মানুষ তো এ সুযোগ পায়! তপন রায় চৌধুরির খ্যাতিমান ছাত্র গওহর রিজভী তখন ঢাকায় ছিলেন না। তিনি থাকলে হয়ত শেখ হাসিনার সঙ্গে তপন রায় চৌধুরির দেখা হতো। হয়ত সে সাক্ষাতের ভেতর দিয়ে দেশের ইতিহাসের কিছু লাভ হতে পারত। কী হতে পারত, কী হয়নি এ সব নিয়ে কল্পনা না করাই ভালো। বাস্তবতা হলো, সেদিন সন্ধ্যার ওই আলোচনায় সালাউদ্দিন আহমেদ, তপন রায় চৌধুরি, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখের গলায় এই উপমহাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে কোথায় যেন একটি শঙ্কা বার বার ফিরে আসছিল। তিনজনই খুব কাছাকাছি সময়ে চলে গেছেন। তাঁরা যখন চলে গেলেন এ সময়টি কী এ উপমহাদেশের জন্য কোন সুসময়? পাকিস্তানে শিশু হত্যায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ চমকে উঠেছে? কিন্তু পাকিস্তানকে নিয়ে এখন যদি শিল্পী হুসেনকে একটি ছবি আঁকতে বলা হতো সে ছবিতে যত রং ব্যবহার হোক না কেন, সব মিলে কি গভীর একটি কালো রং হতো না? ভারতে একবিংশ শতাব্দীতে আবার ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রচ্ছন্ন উদ্যোগে। আর বাংলাদেশ! ধর্মের নামে একটি তথাকথিত রেজিমেন্টাল মৌলবাদ প্রতিদিন সংস্কৃতিকে রাহুর মতো গিলে খাচ্ছে। আর প্রায় সবাই মিলে সে কাজে উৎসাহ যোগাচ্ছে। এই সময়ে মারা গেছেন তপন রায় চৌধুরি। পরিণত বয়সেই মারা গেছেন। তবে একটু চোখ বুজে চিন্তা করলে কি মনে হয় না, ইতিহাসের এই দুঃসময়ে তপন রায় চৌধুরির মতো ঐতিহাসিকের প্রয়োজনীয়তা ছিল আরও বেশি। অর্থনীতির ইতিহাস হাতের তালুতে তুলে তিনি বলতে পারতেন, শুধু অর্থনীতি পারবে না সুন্দর ইতিহাসের পথে নিয়ে যেতে। বলতে পারতেন, আরও কী কী প্রয়োজন। [email protected]
×