ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার দলীয় নেতাদের হাত থেকে ঘষিয়াখালী চ্যানেল মুক্ত করা কঠিন

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

সরকার দলীয় নেতাদের হাত থেকে ঘষিয়াখালী চ্যানেল মুক্ত করা কঠিন

রশিদ মামুন/আহসান হাবিব হাসান, মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল ঘুরে এসে ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবনের জন্য। শ্যালায় তেল ট্যাঙ্কারডুবিতে নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রকৃতির হাতে সুন্দরবনকে ফিরিয়ে দিতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। যদিও প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত রাখাই সব থেকে বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে সাময়িক কার্যক্রমে কোন সুফল পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ বলছে আগামী জুনের মধ্যে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁদের। সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের মংলার অরাজি মাকড়ডোন, নারকেলতলা, শানবান্দা, জয়খাঁ, রামপালের মল্লিকেরবেড়, বহরবুনিয়া, পেড়িখালী, ডাকরা কালিগঞ্জ, প্লানের পাড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে। এসব এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে খনন করা হয়েছে হাজার হাজার চিংড়ি ঘের। এসব ঘেরে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল থেকে ২৪০টি ছোট বড় খাল দিয়ে পানি আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সব খালই প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। জোয়ারে খালে পানি উঠে আসার পর খালের মুখে কৃত্রিমভাবে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। যাতে জোয়ারে পানির চাপ বাড়লেও ভাটায় একই গতিতে নেমে যেতে পারে না। বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যায় মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল। যাতে সুন্দরবনের মধ্যে নিয়ে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিটিএ। এতদিন দখল উচ্ছেদের কোন প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়নি। গত ৯ ডিসেম্বর মংলার অদূরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারি এলাকায় শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ‘এমটি টোটাল’ এর ধাক্কায় তেলবাহী জাহাজ ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নিমজ্জিত হয়। দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটির ট্যাঙ্কার ফেটে সুন্দরবন ও বন সংলগ্ন ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভারি জ্বালানি তেল ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে স্মরণকালের ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। তাঁদের মতে সুন্দরবন মারাত্মক অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে। স্থানীয়রা বলছেন তেল ট্যাঙ্কার ডুবির পর থেকে সরকার সুন্দরবন রক্ষায় যে তৎপরতা দেখাচ্ছে তা আগে শুরু করলে এই ক্ষতি হতো না। বুধবার রাপমাল-মংলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে স্থানীয় প্রশাসন খালগুলো মুক্ত করার কাজ করছেন। তাঁরা বলছেন ২৪০ খালের সবই মুক্ত করা হবে। তবে খালগুলো বন্ধ করে রাখায় জোয়ারভাটার প্রভাব না থাকায় পলি পড়ে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আপাতত খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও খাল খননের কোন প্রকল্প নেই। স্থানীয়রা বলছেন শুধু খাল অবৈধ দখলমুক্ত করলেই হবে না খনন করে পুনরায় যাতে দখল না হয় সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। স্থানীয়রা বলছেন সরকার বদলে শুধু দখলদার বদলায়। কিন্তু খালের অবৈধ দখল অবৈধই থেকে যায়। এখন স্থানীয় সরকারপন্থী নেতারা বেশিরভাগ খাল এবং ঘেরের দখলে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খালগুলো অবমুক্ত করা হলেও কত দিন তা রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। জিউধারা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম বাদশা জানান, ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লক্ষ্মীখালী, সোনাতলা, কালাচাঁন দাড়ি, সরদারবাড়ির সামনের খাল, সোনাতলা লহনীপাশা খালসহ প্রায় ১০ থেকে ১২টি খাল দখল করে রেখেছে। খালগুলো উদ্ধার করে খনন করলে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। এরপরই মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল স্বাভাবিক থাকবে। বুধবার দুপুরে রামপাল খেয়াঘাটে গিয়ে দেখা যায় একের পর এক নৌকা সাজিয়ে ‘নৌকার ব্রিজ’ বানিয়ে মানুষ পারাপার করা হচ্ছে। মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের এই অংশের দুই পাশে একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে। স্থানীয়রা এই চ্যানেলের মধ্যেই ধান চাষ করছেন। ভাটার সময় হেঁটে পার হওয়া গেলেও জোয়ারে ছোট আকারের নৌযান চলাচল করে এই চ্যানেল দিয়ে। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন জানালেন, এখন থেকে সাত আট বছর আগেও এখানে ফেরিঘাট ছিল। দূরেই সেই ফেরিটি চরের ওপর উঠানো দেখিয়ে তিনি বলেন, প্রভাবশালীরাই এই চ্যানেল ধ্বংস করেছে। বছরের পর বছর পানি আটকে রাখার কারণে পলি জমে চ্যানেল ভরাট হয়েছে। তিনি বলেন, ভাটার সময় পানির প্রবাহ না থাকায় সমুদ্র থেকে বয়ে আনা পলি আর সমুদ্রে ফিরে যেতে না পারায় এই চ্যানেল ভরাট হয়ে গেছে। অরাজি মাকড়ডোনে অবৈধ দখল উচ্ছেদকারী সহকারী ভূমি কর্মকর্তা নাজমুল হক জানান আপাতত খালের মুখগুলো কেটে দেয়া হচ্ছে। তবে খননের কোন প্রকল্প নেই। উচ্ছেদ করতে গিয়ে কোন ধরনের বাঁধা পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি। জানতে চাইলে বলেন, কোন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা বা শাস্তি দেয়ার বিষয়ে তাদের কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর পর মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল দিলে নৌযান চলাচল শুরু হয়। এর আগে শ্যালা নদীর মাত্র দেড় কিমি পথ পাড়ি দিয়ে নৌযান ভোলা নদী হয়ে মংলা এবং খুলনায় আসত। এখন ভোলা অবৈধ দখল আর পলি জমে বন্ধ হয়ে গেছে। যাতে করে এখন শ্যালা হয়ে দুধমুখী দিয়ে বলেশ্বর দিলে নৌযান চলাচল করে। সরকারের নির্দেশে সাময়িক বন্ধ থাকলেও স্থানীয়দের একটি অংশ শ্যালা নদী দিয়ে পুনরায় নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে মানববন্ধন করে এরা শ্যালায় পুনরায় নৌযান চলাচলের অনুমতি চাইছে। কেউ বলছেন একবার শ্যালায় চলাচলের অনুমতি দিলে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের ওপর চাপ কমে যাবে। যাতে অবৈধ দখল উচ্ছেদের প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে, যা দখলদারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক সংঘর যুগ্ম সম্পাদক আবুল হাসান বাবুল বলেন, দেশ স্বাধীনের পর থেকে তিনি মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল ব্যবহার করেই নৌযান চলাচল করতে দেখেছেন। কিন্তু আশির দশক থেকে চিংড়ি চাষ শুরুর পর থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালগুলো দখল করে নেয়। আর ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে এই চ্যানেল। সময়মতো উদ্যোগ নিলে আজকের এই বিপর্যয় হতো না বলে মনে করেন তিনি। সূত্র মতে, ২০১১ সালের এপ্রিলে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান আটকে গেলে বিআইডব্লিউটিএ তড়িঘড়ি শ্যালায় নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বন বিভাগ ২০১১ সালের ২১ আগস্ট থেকে গত তিন বছরে সাতটি চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিএকে। প্রতিটি চিঠিতেই চাঁদপাই রেঞ্জকে ডলফিনের অভয়ারণ্য এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে এই এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করার আহ্বান জানায়। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের ৪৪০টি বাঘের মধ্যে ৬৩টি রয়েছে এই চাঁদপাই এলাকায়। রয়েছে অসংখ্য চিত্রল হরিণ। বন বিভাগের চিঠিতে এসব পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়, চলাচলকারী যান্ত্রিক নৌযান ও জাহাজগুলো হাইড্রোলিক হর্ন বাজাচ্ছে, তেলসহ দূষিত বর্জ্য পানিতে ফেলছে। এর ফলে নদীর ডলফিন এবং বনের বাঘ ও হরিণসহ এখানকার জলজ ও বন্যপ্রণীর অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে রয়েছে। ক্রমাগত নদীর পানি দূষিত হলে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ জন্মের হারও কমে যাবে, যা এ এলাকার প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ বন বিভাগের কথায় কর্ণপাত করেনি। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ এ নৌরুটে পলি জমে ২০০৪ সাল থেকে মারাত্মক নাব্য সংকট দেখা দেয়। তা সত্ত্বেও সরকারের সীমিত বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পলি অপসারণ করে নৌপথটি সচল রাখে। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১১ সালের এই উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যখন পলি পড়ে পুরো এলাকা ভরাট হওয়ার অনেক পরে খনন শুরু করে। বন ও বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর ৩০নং আইন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ সংশোধন)- ২০১০ অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী, সুন্দরবন আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করে। ওই কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোন ধরনের তৎপরতা চালাবে না। এছাড়া ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ (বিশ্ব ঐতিহ্য) হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক জলাভূমি দূষিত এবং এর জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত করে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ বেআইনী। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর দুই পাশে বাঁধ নির্মাণ করায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করলেও এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ওই পরিকল্পনা বাতিল করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। নৌযান চলাচলের কারণে এরই মধ্যে শরণখোলায় ৩০ ফুট এলাকার বন বিলীন হয়েছে নদীতে। বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলা ঘিরে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনে বিস্তৃত এক লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা সুন্দরবন। জানতে চাইলে বিআইডব্লিটিএর খনন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল মতিন জনকণ্ঠকে বলেন, জুনের মধ্যে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে বিআইডব্লিটিএ, বসুন্ধরা গ্রুপ এবং চায়না হারবার মিলে খনন কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। গত জুলাই থেকে চলা খননকাজ এখন চারটি ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার আরও একটি ড্রেজারের যাওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরও তিনটি ড্রেজার খননকাজে যোগ দেবে। তিনি বলেন, সব খাল মুক্ত করা হলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকবে। এসে সমুদ্র থেকে জোয়ারের পলি আবার ভাটায় সমুদ্রে চলে যবে। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই চ্যানেল সচল রাখার বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে মংলা এবং খুলনার কোন নৌযান চলাচল বন্ধ করা যাবে।
×