ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বুয়েট ক্যাম্পাসে অযত্ন অবহেলায় কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কবর

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বুয়েট ক্যাম্পাসে অযত্ন অবহেলায় কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কবর

আশরাফুল আনোয়ার ॥ ‘পলাশীর সব মানুষ বলল, বনি আমাদের এলাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর কবর আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। এলাকাবাসীর এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে আমলে নিয়েই তাঁর ছোট ভাইয়ের লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফনের সিদ্ধান্ত পাল্টে পলাশীর ব্যারাকসংলগ্ন স্থানে দাফনে রাজি হন তিনি। সেই জায়গাটা এখন বুয়েটের দখলে। তারা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ফেলে রেখেছে অযতœ-অবহেলায়। নিজেরা তো সংস্কার করেইনি, আমাদেরকেও অনুমতি দেয়নি। এমনকি কবরটির নামফলক লেখানোর সময়ও বাধা দিয়েছে। রাজধানীর পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শফিকুর রহমান বনির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অভিমানী কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন অসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকরিজীবী সৈয়দ মতিউর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর রণাঙ্গন থেকে ফেরার পথে ঢাকার অদূরে কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়া নামক স্থানে বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্মান্তিক নৌকাডুবিতে বনিসহ আরও ১১ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ওই দুর্ঘটনায় শহীদ ৯ জনকে আজিমপুর কবরস্থানে (নতুন) দাফন করা হয়। আজিমপুরে দাফন হওয়া বনির সহযোদ্ধা শহীদ আবুল হোসেন পরবর্তীতে বীর প্রতীক খেতাবও পান। একজনকে দাফন করা হয় রাজধানীর মৌচাকে পারিবারিক কবরস্থানে। আর এলাকাবাসীর ইচ্ছায় বনিকে কবর দেয়া হয় পলাশীতে (সূত্র : শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফাউন্ডেশন)। বুয়েটের বর্তমান জাপান ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন এ্যান্ড আরবান সেফটি (জিডপাস) ভবনের পাশেই মুক্তিযোদ্ধা বনির কবর। কবরসংলগ্ন জায়গাটি একসময় পলাশীর ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পরেই জায়গাটি নিজেদের দখলে নেয় বুয়েট। বনির সঙ্গে শহীদ হওয়া অপর ১০ মুক্তিযোদ্ধার কবর যতেœ থাকলেও বনির সমাধিস্থলের অবস্থা বর্তমানে খুবই করুণ। মঙ্গলবার বুয়েটের জিডপাস ভবনের পাশে সরেজিমন ঘুরে দেখা যায়, কবরে বনির নাম উৎকীর্ণ ফলকটি বিবর্ণ ও ভাঙ্গাচোরা। চারপাশে জং ধরা নড়বড়ে তারের বেড়া ঝুলে আছে। কবরের দক্ষিণ প্রান্তের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে আছে কবরের পায়ের দিকে। সংলগ্ন চারপাশের জায়গায় মাটি ভরাট করায় কবরটি গর্তের মতো হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে তা পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায় বলে জানালেন জিডপাসের নিরাপত্তা প্রহরীরা। বুয়েট কর্তৃপক্ষ জানে কবরটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। তবুও রহস্যজনক কারণে এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি তারা। এমনকি নিকট ভবিষ্যতেও কবরটি সংস্কারে তাদের কোন পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন বুয়েটের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. একেএম মাসুদ। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কবরটি সংস্কারে আপাতত কোন পরিকল্পনা বুয়েটের নেই। তবে শহীদের পরিবার চাইলে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কবর সংস্কারের অনুমতি তারা হয়ত পেতে পারেন।’ শহীদের বড় ভাইয়ের অভিযোগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, ‘আগে এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে আমার তা জানা নেই। কবরে ফুল দিতে যাওয়ার ব্যাপারে কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই। শহীদের স্বজনেরা চাইলে যে কোন সময় বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন।’ একাত্তরে ২ নম্বর সেক্টরে বনির সহযোদ্ধা ছিলেন মো. ইমামুল কবীর শান্ত (গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফাউন্ডেশন গত ১৫ ডিসেম্বর কবরটির সংস্কারে অনুমতি চেয়ে বুয়েটের উপাচার্যকে চিঠি দেয়। একসপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত চিঠির জবাব মেলেনি। চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও কবে নাগাদ এর জবাব দেয়া সম্ভব হবে রেজিস্ট্রার তা বলতে পারেননি। তিনি বলেন, চিঠির বিষয়বস্তু পুরোপুরি মনে নেই। তবে যাচাই-বাছাই করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এজন্য কিছুটা সময় লাগবে।’ সৈয়দ মতিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর পর আমার বাবা সৈয়দ মহম্মদ আলী ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। বঙ্গবন্ধু বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কিছু চান কি না। তখন আমার বাবা বলেছিলেন, ছেলের প্রাণের বিনিময়ে কিছু চান না। তার এক ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু চাইলে তার আরও ৩ ছেলেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছেন। আমার সেই বাবা মারা যাওয়ার আগে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কবরের জীর্ণদশা দেখে আফসোস করেছেন। আমাদের পরিবারের কোন দাবি নেই- শুধু ভাইয়ের কবরটি সংস্কারের অনুমতি দিলে এবং সরকার তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেই আমরা খুশি হব। রণাঙ্গনে কিশোর বনি : একাত্তর সালে বনির বয়স ১৮। চার ভাই ও একবোনের মধ্যে বনি সবার ছোট। পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ৩৩/১, পলাশী ব্যারাকে। সে বছরই বনির ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কথা। চারপাশে যখন যুদ্ধের দামামা, তখন কি আর পড়ার টেবিলে মন বসে। বনি মনে মনে ঠিক করলেন যুদ্ধে যাবেন। বাবাকে বললে অনুমতি পাওয়া যাবে না। তাই বনির কিশোর মন আশ্রয় নিল কৌশলের। অনুমতি নিয়ে প্রথমে চলে গেলেন গ্রামের বাড়ি তৎকালীন ফরিদপুর জেলার (বর্তমানে শরীয়তপুর) কাঠুহুগলী গ্রামে। সেখান থেকে সোজা মেলাঘরে (ভারতের ত্রিপুরায় মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প)। সেখান থেকে খবর পাঠালেন যে তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গেছেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করে তবেই ফিরবেন। ছোট ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি মনে করে এভাবেই বললেন মতিউর রহমান। কিশোর মুক্তিযোদ্ধার পরের কাহিনী শোনান ২নং সেক্টরে তার সহযোদ্ধা (গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা) গোলাম মর্তুজা পাইকার। ৪৩ বছর আগের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বনিসহ তারা অনেকে মে মাসের মাঝামাঝি ত্রিপুরা সীমান্ত পার হন। তারপর আগরতলার কাছে মেলাঘর ও অম্পিনগরে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নেন। সেখানে তারা মেজর হায়দায়ের তত্ত্বাবধানে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রশিক্ষণ শেষে বনি ও তাকে খালেদ মোশারফের নেতৃত্বাধীন ২নং সেক্টরভুক্ত করা হয়। তাদের জন্য অপারেশনের স্থান হিসেবে চিহ্ণিত হয় ঢাকার লালবাগ থানা এলাকা। সেখানে কমান্ডার মোরশাররফ হোসেনের (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী) নেতৃত্বে অপারেশনে অংশ নিতেন। এসব অপারেশনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম (বর্তমানে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী) ও সাদেক হোসেন খোকাও (ঢাকার সাবেক মেয়র) তাদের সহযোদ্ধা ছিলেন।
×