ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মেধা আকর্ষক বেতন

প্রকাশিত: ০৩:০২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

মেধা আকর্ষক বেতন

বরেণ্য কথাশিল্পী শওকত ওসমান ১৯৭৪ সালে লিখেছিলেন একটি একাঙ্কিকা ‘আমি কেন বেতন পাই।’ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ঠাসা নাটকের প্রধান চরিত্রটি অফিসে যাতায়াত করেন। অফিসে আড্ডা মেরে কাটে সময়। কাজ নেই। তাই খই ভাজার মতো অবস্থা। এক সময় নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে- ‘আমি কেন বেতন পাই।’ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আরেক দফা বৃদ্ধির প্রস্তাব ও সুপারিশ দেখে একাঙ্কিকাটির কথা মনে পড়তেই পারে। প্রশাসনকে গতিশীল করার জন্য যেমন মেধাবী, দক্ষ, সৎ, কর্মনিষ্ঠ, কুশলী কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন, তেমনি তাদের জীবনযাপনকে সহনশীল রাখার জন্য গতিশীল ও জীবনধারক বেতন কাঠামোও জরুরী। বেতন বৃদ্ধি চাকরিজীবীদের জন্য সুসংবাদ বৈকি। সরকারী কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ নির্দিষ্ট আয়ের সীমায় তাদের জীবন নির্বাহ করতে হয়। আর্থিক দুশ্চিন্তামুক্ত হলে কর্মক্ষমতা বাড়ে। কাজের মান ও গতিও হয় উন্নত পর্যায়ের। তাই বছর শেষে প্রায় ১৪ লাখ সরকারী কর্মজীবীর জন্য নয়া বেতন স্কেল ঘোষণা প্রশাসনে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনয়নে ব্যাপক সহায়ক হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে সরকারী পর্যায়ের বেতন কাঠামো বেসরকারী বেতন কাঠামোর তুলনায় ম্লান। বেসরকারী খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা প্রদান করে মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ দিচ্ছে। বিশ্বায়নের এই কালে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক দেশও বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। সে তুলনায় সরকারী চাকরির একক কৌলীন্য তেমন নেই। বৈষয়িক প্রণোদনা ছাড়া কেবল দেশপ্রেম আর সমাজ ভাবনার আহ্বান দিয়ে আকর্ষণ করা যায়নি দীর্ঘসময়। ফলে মেধাহীন, চেতনায় দুর্নীতি, কম জানাদের ভিড় বেড়েছে সরকারী চাকরিতে। নানা তদ্বির ও সুপারিশে যেন মেধাহীনদের আশ্রয়স্থল সরকারী দফতর-অধিদফতরগুলোও। ঘোষিত নতুন সরকারী বেতন স্কেল বেসরকারী স্কেলের সঙ্গে ব্যবধান ঘুচিয়ে আনায় সহায়ক হবে। সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রার মান বাড়বে। আর তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মদক্ষতা, সততা, নিষ্ঠার বৃদ্ধি ঘটানোও আবশ্যক। নতুবা ‘আমি কেন বেতন পাই’ বলে বিবেকের দায় মেটানো কঠিন হবে। নতুন বেতন স্কেলে সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা নির্ধারণের যে সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন কমিশন তা হুবহু গ্রহণ ও কার্যকর করা গেলে বেসরকারী খাতের সঙ্গে বৈষম্য দূরীভূত হবে। মেধাবী, দক্ষ ও ইংরেজী জানা উদ্যমীরা সরকারী চাকরিতে আগ্রহী হবে। আর এমন কর্মজীবীরাই দেশকে গতিশীল ও উন্নত দেশে পরিণত করায় হবে সহায়ক। নিকট অতীতে বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ যে সর্বার্থে সুফল বয়ে এনেছে তা নয়, বরং তিক্ত অভিজ্ঞতার বহর বেড়েছে। বাড়তি যে বেতন মেলে তার একটা অংশ গ্রাস করে মূল্যস্ফীতি। ফলে বর্ধিত বেতন গলার কাঁটা হয়ে ওঠার ইতিহাসও রয়েছে। জনগণের বিভিন্ন অংশের ওপরও বেতন বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাদের তো আর বেতন বাড়ে না, কিন্তু উত্তাপ সহ্য করতে হয় বাজারে বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ার আগুনে। এই যে প্রস্তাব ও সুপারিশ পেশ হলো তা গৃহীত ও বাস্তবায়নের আগেই বাজারে পণ্যমূল্য বাড়তির দিকে ধাবিত হতে থাকবে। সরকারী কর্মকর্তাদের সচ্ছল, আরামদায়ক জীবনযাপন ব্যবস্থার বিনিময়ে জনগণ কি পাবে- এমন প্রশ্ন উত্থাপন স্বাভাবিক। লালফিতার দৌরাত্ম্য, ঘুষ, দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে প্রশাসন বেরিয়ে আসবে কিনা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত রাখা দরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেতন বৃদ্ধির এই সুপারিশ সঙ্গত। তবে যে লক্ষ্যে এই সুপারিশ করা হয়েছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত হবে সেটাই সবার প্রত্যাশা।
×