ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৩ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

২৩ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী দানবের তরে নয়, হবে হবে হবে জয়‘, গুন গুন করে এই গানের কলিটি এক মনে তাঁর জলদ গম্ভীর গলায় ভাজছিলেন রাজনীতির কবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বার বার বাধা পড়ছিল। একের পর এক পতাকাশোভিত ঝাঁজাল মিছিল জোয়ারের উচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়ছিল গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাতিঘরের পাদদেশে। জাতির জনক সালাম নিচ্ছিলেন। একই কথা বৃত্তি করছিলেন, ‘লড়াই চলছে লড়াই চলবে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। ঐক্যবদ্ধ হও। প্রস্তুত হও। বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ্...জয় বাংলা।’ গল্প, গান, গদ্য-পদ্য সবই উদ্ধৃতি উপমা উৎপ্রেক্ষায় বিদ্যমান ছিল তাঁর বজ্রকণ্ঠের সুললিত ভাষণের নানা স্তরে বিন্যাসে। কখনও কখনও রাজনৈতিক ভাষণ গদ্যকাব্য এবং মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় হয়েছে। কর্মী থেকে নেতা এবং ডেমোগগ থেকে জনগণ মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিকে পরিণত হয়েছেন। গুণগত মানে উচ্চতায় উৎকর্ষে গুরুত্বে তাৎপর্যে জর্জ ওয়াশিংটন, মাও সেতুং, লেনিন, মার্টিন লুথার কিংয়ের স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পাশ্চাত্যের নন্দিত সাময়িকী নিউজউইক রাজনীতির কবি অভিধায় অলঙ্কৃত করেছে বাঙালীর নেতাকে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে প্রচলিত অর্থে গান চর্চিত হতে শুনিনি কখনও আগে। বিপ্লবী কিংবদন্তি ফিদেল ক্যাস্ট্রো যথার্থই মুজিবের মাঝে হিমালয়ের বিশালত্বকে অবলোকন করেছিলেন (১৯৭৩)। সেদিন সকালে বঙ্গবন্ধু হাত তুলে জনতার অভিবাদন নিচ্ছিলেন। হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন বীর জনতাকে। ছোট্ট শিশু রাসেল আর আমি গাড়ি বারান্দার ছাদের ওপর তাঁর পায়ের কাছে বসেছিলাম। আমার টেপরেকর্ডারের মাউথ পিসটা বাঁধা ছিল মাইক স্ট্যান্ডের সঙ্গে। তবুও যান্ত্রিক ব্যত্যয়ের আশঙ্কায় সাবধানী আচরণে নোট নিচ্ছিলাম। শিশু রাসেল একবার তাকাচ্ছিল জনতার সাগরের উত্তাল-উদ্দাম ঊর্মিমালার দিকে আর একবার তার মহান পিতার শপথদীপ্ত মুখোম-লের দিকে। মাঝে মধ্যে আমার ঢাউস টেপরেকর্ডারের ওপর হাত বুলাচ্ছিল একটু নাড়াচাড়া করার ইচ্ছে নিয়ে। দোতলার বারান্দায় রেলিংটার ওপর ভর দিয়ে গণআবেগের উদ্দাম দৃশ্য অবলোকন করছিলেন বেগম মুজিব ও তাঁর অন্য সন্তানরা। সেদিন ছিল ২৩ মার্চ ১৯৭১। দুদিন পরই এসেছিল কৃষ্ণপক্ষের সেই ভয়ানক অমানিশি। মৃত্যুবিভীষিকার ভয়াল রাত। ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় সেনা সদরে কর্মরত বাঙালী সৈনিকদের অস্ত্রচ্যুত করে নজরবন্দী করা হলো। ১২:০১ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। গ্রেফতার হলেন। রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর কামানের গোলায় তছনছ হলো। বাঙালী পুলিশের কাছ থেকে সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হলো। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বিপুলসংখ্যক বাঙালীকে হত্যা করা হলো। পিলখানা ইপিআর সদর দফতর থেকে সশস্ত্র হামলার মুখে বাঙালী জোয়ান ও অফিসাররা উৎখাত হলেন অনেকে নিহত হলেন। ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেতার ট্রান্সমিটারটি উৎপাটিত হলো। বলধা গার্ডেন থেকে ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেতার ট্রান্সমিটার উঠিয়ে আনার সময় কিউরেটরকে হত্যা করল হানাদাররা। তবুও খালি হাতে নিরস্ত্র বাঙালী প্রতিরোধ যুদ্ধে মগ্ন হলো কোন্ মন্ত্র বলে? তোপদেগে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে ছাত্রদের গড়া প্রতিরোধ দুর্গ গুঁড়িয়ে দিল হানাদাররা। শত শত লড়াকু ছাত্র নিহত হলো। বাঙালী সেনা সদস্যদের সশস্ত্র বিপ্লবের রূপকার ও আগরতলা মামলার দ্বিতীয় প্রধান অভিযুক্ত নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ধরা পড়ে নিহত হলেন ভোরের আগেই। ভোর হতেই পলাশী মোড়ে ১০০ ফায়ারম্যানকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হলো। এসব ঘটনার মধ্যে অনেক অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কিন্তু রাত ১২টা ১ মিনিটে যা যা হতে পারেনি জাতির জনকের খুব কাছের কোন মানুষের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতায় সেগুলো ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামে অপারেশন সূর্যসেন ক্লিক করেনি ‘পঞ্চম বাহিনীর’ তৎপরতায়। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ‘৫ম বাহিনীর’ একজন দৃশ্যমান মুখ্য নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিবর্তে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা দিয়ে অশুভ শক্তির অস্তিত্বের জানান দেন। সেই মোনাফেক একদিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে পড়ে বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রীম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট মেনে জাতির জনকের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি হুবহু পাঠ করে। ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলাকালে জাতীয়তাবাদী জেনারেল এমিলিও মোলা সর্বপ্রথম ‘শত্রুর চর’ অর্থে ‘ফিফথ কলাম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। স্মরণযোগ্য যে, জেনারেল এমিলিও মোলা বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর ৪টি বিশ্বস্ত ও অনুগত কলাম রয়েছে তাঁর নিয়ন্ত্রণে আর বোমা বিক্ষত মাদ্রিদ নগরীতে ঘাপটি মেরে আছে তাদের গোপন সহযোগী পঞ্চম বাহিনী। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মাদ্রিদ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘দি ফিফথ কলাম এ্যান্ড দি ফার্সট ফোরটি নাইন স্টোরিজ-ঞঐঊ ঋওঋঞঐ ঈঙখটগঘ অঘউ ঞঐঊ ঋওজঝঞ ৪৯ ঝঞঙজওঊঝ’ শিরোনামে তাঁর প্রথম নাটকটি লেখেন। সেই ফিফ্থ কলামের গোপন তৎপরতায় কুমিল্লা ময়মনসিং ও বগুড়ার কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। কিন্তু ‘ষষ্ঠ বাহিনী’ বৃহত্তর যশোরের মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও সদর মহাকুমা থেকে লাঠি, বন্দুক, লগি-বৈঠা, ঢাল-সড়কি বল্লম ও তীরধনুক দা কুড়াল সজ্জিত লাখো মানুষ ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ সেনানিবাস ঘেরাও করেছিল জাতির জনকের নির্দেশে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের সেই গণ অবরোধ ভাঙতে তিন দিন লেগেছিল আবদ্ধ পাকিসেনাদের। বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট না উড়লে যশোর শত্রুমুক্ত থাকত আরও কতদিন সেটা অনুমান করা বেশ কঠিন। ঠিক অমনটাই ঘটার কথা ছিল ঢাকা সেনানিবাস ঘিরে। তার জন্যই পুলিশ ইপিআর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা প্রস্তুত ছিল। প্রস্তুত ছিল বছিলা, গাবতলী ও কামরাঙ্গীর চরের কয়েক লাখ কৃষক জনতা! এই গোপন পরিকল্পনার কথা জানতেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম আওয়ামী লীগের ৩ জন মাত্র শীর্ষ নেতা। তাঁদের ২ জন ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা-২’ কার্যকর করেছিলেন ভারতে গিয়ে। ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন। আত্মগোপনে গেলেন না। ভারতেও গেলেন না। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ‘শ্বশুরবাড়ি’ থেকে ঢাকায় ফিরলেন। তাঁকেও বঙ্গবন্ধু ক্ষমার চাদরে ঢেকে রেখেছিলেন। এখন গল্প মনে হলেও ইতিহাস নিশ্চই একদিন সত্যের স্বরূপ প্রকাশ করবে। কথিত আছে, ভারতের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কারারুদ্ধ তিন শীর্ষ নেতার মধ্যে একজন ছিলেন ব্রিটিশ চর। গোপন সূত্রে বাঙালীর মরণ কামড়ের পরিকল্পনা জানতে পেরে ২৫ মার্চ দুপুরে মদমত্ত ইয়াহিয়া তড়িঘড়ি শীর্ষ জেনারেলদের জরুরীসভা ডেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুমোদন করেন। চটজলদি গবর্নর ও জিওসি পরিবর্তন করা হয়। বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খান ও কট্টর জেনারেল নিয়াজি গণহত্যার দায়িত্ব পান। বিকেল ৫টায় পিআইএর একটি বিশেষ বিমান তেজগাঁ অনির্ধারিতভাবে বন্দরে অবতরণ করে। শেরাটনের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পতাকা ও নিরাপত্তাবিহীন মার্সিডিজ চেপে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে চুপিসারে হুটহাট নিষ্ক্রান্ত হতে দেখতে পাই। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×