ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিজ দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী অবস্থান জানালেন প্রশাসনকে ॥ চরম সতর্কবার্তা

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

নিজ দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী অবস্থান জানালেন প্রশাসনকে ॥ চরম সতর্কবার্তা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ত্রাসী যেই হোক বা যে দলেই হোক, কোন অনুকম্পা বা ছাড় নয়, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর দলেরও কেউ অপরাধ বা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধীই। সে কোন্ দলেণ্ড তা জানতে চাই না। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতেই হবে। সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক শেষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রংপুর এবং বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারদের এ নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ সন্ত্রাসী বা অপরাধীদের জন্য একটি চরম সতর্ক বার্তা বলেই মনে করছেন প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর এই চরম সতর্ক বার্তা মাঠ পর্যায়ে সন্ত্রাসী বা অপরাধীদের দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে বসে এই ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা জানতে চান। মাঠ প্রশাসনের কিছু সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক কিছু নির্দেশনাও দেন। গত নবেম্বর থেকেই মাসে দুইবার এভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নয়, সরাসরি খোদ সরকারপ্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী স্থানীয় ও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তারা দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন। গত ২৪ নবেম্বর মৌলভীবাজার জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের পর প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, আজ শুরু করলাম, এরপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে সবাই সব সময় তৈরি থাকবেন। আপনারা কে কী কাজ করছেন, সমস্ত ডাটা নিয়ে রেডি থাকবেন। যে কোন সময় বসব, কথা বলব এবং জিজ্ঞেস করব- যার যার এলাকায় কি কি কাজ হচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ঘটনায় সরকারকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। বিশেষ করে সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের ভয়াবহ সংঘর্ষে গুলিতে সুমন চন্দ্র দাস নামের এক বহিরাগত ছাত্র নিহত হন। সুমন নিজেও একজন ছাত্রলীগ কর্মী। শুধু সিলেটেই নয়, দেশের বিভিন্নস্থানে সরকারী দলের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ ও বিভেদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকারের উচ্চ মহলেও ক্ষোভের সৃষ্টি করে । শুধু সরকারী দলের মধ্যেই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষেও দু’জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সরকার যে ক্ষুব্ধ এবং কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে তা-ই সোমবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে পরিষ্কার হয় গেছে। এর আগে গত ২৪ নবেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রথম ভিডিও কনফারেন্সেও প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস কোন অবস্থায় বরদাস্ত করা হবে না। কারও মুখের দিকে না তাকিয়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি নির্দেশ দিচ্ছি, যারাই সন্ত্রাস করবে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস চালাবে; সে কোন্ দলের সেটা না দেখে যারা এ ধরনের কর্মকা- করবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ পাওয়ার পর সিলেটে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত কয়েক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করে পুলিশ প্রশাসন। সোমবারের ভিডিও কনফারেন্সেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়। গত মাসে রংপুরে পরিবহন শ্রমিক-মালিকের বিরোধের জের ধরে এক আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন। এরপর সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। রংপুরের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ইমরান হোসেনকে কুপিয়ে হত্যার ওই ঘটনায় মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফুল আলমকেও আসামি করা হয়। সোমবারের ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই আওয়ামী লীগ নেতা খুন হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেভাবেই হোক উন্নতি করতে হবে। যারাই সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষ স্বস্তি ও শান্তিতে বসবাস করবে এটাই আমরা চাই। তাই অপরাধীদের কোন দলীয় পরিচয় দেখলে চলবে না। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে অপরাধী তাকে কঠোরহস্তে দমন করে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধী কোন্ দলের তা জানতে চাই না। কারও দিকে মুখ চেয়ে নয়, অপরাধ করলে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্পষ্টভাষায় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে জানিয়ে দেন, অপরাধী যদি আমার দলেরও হয় তবু কোন ছাড় দেবেন না। সবাইকে জানিয়ে দেবেন, এটা আমরা নির্দেশ। তিনি বলেন, ক্ষমতায় এলে কিছু লোক জুটে যায়, যাদের মানসিকতাই হলো অপরাধ করা। তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। অপরাধ করে তারা আর দায় আসে সরকারের ওপর। তাই কারও মুখ চেয়ে নয়, যে দলের লোকই অপরাধ করুক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ কোনভাবেই সহ্য করবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কোন অজুহাত শুনতে চাই না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেভাবেই হোক উন্নতি করতে হবে। যারাই সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদক চোরাচালানে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদ ও মাদক চোরাচালানি এরা কোন দলের হতে পারে না। বর্তমান সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধেও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বলেন, মাদক একটি জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। দেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই মাদকের ব্যাপারে কঠোর হবেন। মাদকসেবীকে ধরে প্রথমে ডাক্তারের কাছে নিয়ে ভাল করে ‘ওয়াশ’ করাবেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেবেন। এতে পেট ওয়াশের ভয়ে অনেকে মাদক সেবন থেকে বিরত হবে। পাশাপাশি মোটিভেশনের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো দিয়ে যাতে মাদক আসতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে মিলে মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। মাদক চোরাচালানিরাও যেই হোক না কেন, এদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
×