ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শুভ বড়দিনের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

শুভ বড়দিনের প্রস্তুতি

দরোজায় কড়া নাড়ছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বড়দিন, মেরি ক্রিসমাস। কাল বাদে পরশু পঁচিশে ডিসেম্বর শুভ বড়দিনে দিনভর প্রার্থনা, আর আনন্দ আয়োজন চলবে। ইংল্যান্ডে দেখে এসেছি বড়দিনের তিন মাস আগে থেকেই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেতে। ঢাকায় ডিসেম্বর মাস না আসা পর্যন্ত ঠিক উৎসবের আমেজ আসে না। গীর্জা কর্তৃপক্ষ এবং খ্রিস্টান বিভিন্ন যুব সংগঠনের উদ্যোগে সন্ধ্যায় বড়দিনের কীর্তন আয়োজন করা হয়। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শীতকে অগ্রাহ্য করে শহরময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেচে গেয়ে কীর্তন পরিবেশন করে বড়দিনকে স্বাগত জানান। পাড়ার মধ্যে হেঁটে যেমন সংকীর্তন করা হয়, তেমনি আবার অতি উৎসাহী দল গাড়ি নিয়ে শহরের এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঘুরে যিশুর জন্মবার্তা ঘোষণা করে থাকে। বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান কমিউনিটি মিরপুর এলাকায়। বিগত ১৮ বছর ধরে মিরপুর আন্তঃমাণ্ডলিক বড়দিন উদযাপন কমিটি ২৫ ডিসেম্বরের আগে বিশেষ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। যুব সংগঠক প্রলয় সমদ্দার বাপ্পি এ উৎসব আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন যেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী অতিথিরাও আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। গত ২০ ডিসেম্বর মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে এবারও অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা কাউকে অনেকখানি ছুঁয়ে যায়, আবার কেউ বা যথেষ্ট আলোড়িত হন না। বিশেষ করে একটু বয়স হয়েছে যাদের। মুসলমানদের ঈদ যেমন শিশু-কিশোর ও অল্প বয়সীদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয়, বড়রা কেবল সামাজিকতা পালন করেন। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও যেন অনেকটা সেরকমই। একজন কর্মজীবী গৃহিণী বললেন, ‘পরিবার আর আত্মীয়স্বজনের কথা মাথায় রেখে কিছু প্রস্তুতি তো প্রতিবারই নিতে হয়। ঘর গোছানো, ঘরে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, বাজার ঘুরে যেটুকু না করলেই নয় তেমন কেনাকাটা, উপহারসামগ্রী প্রস্তুত করা আর ভালমন্দ কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা- এই হলো আমার বড়দিনের প্রস্তুতি। জীবিকার তাগিদে খুব বেশি কাজের চাপে আছি বলে এবার এখনও ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়নি। ছেলেকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। আশা করছি সবুজ গাছটা বড়দিনের আগে যে কোনদিন ঝলমল করে উঠবে। ছেলেকে দেখেই আমি আমার শৈশবের বড়দিনগুলোতে ফিরে যাই। সংসারের দায়িত্বভার কাঁধে চাপার আগের আর পরের বড়দিনগুলোর মধ্যে কতই না ব্যবধান!’ বড়দিন নিয়ে আলাপ করেছিলাম একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থার প্রাক্তন কর্মকর্তা কেকা অধিকারীর সঙ্গে। সাহিত্যচর্চা করেন বলেই তাঁর কথায় গভীর সংবেদনশীলতা পেলাম। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে যে সমাজ, সেখানে নাগরিকদের পারস্পরিক ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণের বিষয়টি তাঁর কথায় সুন্দরভাবে এসেছে। কেকা বললেন, ‘শৈশবে আমরা থাকতাম কলাবাগানে। সব মুসলিম আর দু’ঘর হিন্দু প্রতিবেশীর মধ্যে আমরাই ছিলাম একমাত্র খ্রিস্টান পরিবার। পড়তাম লেক সার্কাস স্কুলে। একটা সময় ছিল যখন ক্লাসে তো বটেই, পুরো স্কুলেও একমাত্র খ্রিস্টান ছাত্রী ছিলাম আমি। ২৫ ডিসেম্বর এলেই বন্ধুরা বলতে আরম্ভ করত, ‘বড়দিনে তোরা কী করিস? এবার বড়দিন কোথায় করবি? আমাদের গীর্জায় নিয়ে যাবি? বড়দিন দেখব।’ বড়দিনের কথা বলতে পেরে আনন্দ পেতাম, আবার মাঝে মাঝে কারও কারও বড়দিনে বাসায় আসার আগ্রহ দেখে মনে মনে রাগও হতো খুব- প্রতিবছর দু’দুটো করে ঈদ যায়, কই তখন তো একবারও আমার কথা মনে পড়ে না! মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। তাই সবাইকে তো আর বলা সম্ভব হতো না, মা’কে বলে কয়েকজন কাছের বন্ধুকে নিমন্ত্রণ জানাতাম। তৃষ্ণা, নাজমা, নিগার, শায়লা, লুনাকে সত্যি সত্যি মন থেকেই চাইতাম। কারণ প্রতিটি ঈদে ওদের বাসায় আমার নিমন্ত্রণ অবধারিত ছিল। ছোটবেলায় বড়দিনের সকালে গীর্জায় যেতাম। কোন কোন বছর গীর্জায় প্রীতিভোজ হতো অর্থাৎ গীর্জার সদস্য পরিবারগুলো একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ও গিফট এক্সচেঞ্জ বা উপহার দেয়া-নেয়া হতো। আমার উপহারটি কে পান আর আমিই বা কার কাছ থেকে উপহার পাচ্ছি তা ভেবে মনে খুব উত্তেজনা হতো। কিন্তু দুপুরের পর বাসায় ফিরে অন্তরটা কেমন যেন মিইয়ে আসত আশপাশের বৃহত্তর পরিবেশে উৎসবের কোন চিহ্ন থাকত না বলে। যদিও বন্ধুরা বিকেলে বাসায় আসতে শুরু করলে মনটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠত। কলেজজীবনে মুসলিম বান্ধবী মুক্তাকে না পেলে আমার বড়দিনের আনন্দ পূূর্ণ হতো না। পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে দেখি, আমার বড়দিনগুলো আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে আসলে আমার মুসলিম বন্ধুরাই। তাদের ধর্মবিশ্বাস আমার আনন্দে বাধা হয়নি কোনদিন। আনন্দ আর ভালবাসাটাই যে সেখানে মুখ্য ছিল।’ প্রিয়জন ছাড়া বড়দিনের আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে ওঠে। গল্পকার কেকা অধিকারী এবারই প্রথম বাবাকে ছাড়া বড়দিন করছেন। তারপরও তিনি মানেন বাবাকে অন্তরে নিয়েই দিনটি অতিবাহিত হবে। পরিবারে সবাইকে নিয়ে সকালে গীর্জায় যাবেন। সুসমাচার প্রচার শুনবেন, প্রার্থনা করবেন, গান গাইবেন- ‘আজ শুভ বড়দিন ভাই, আজ শুভ বড়দিন ... খ্রিস্ট যিশু এলেন ভবে পাপীরে করিতে ত্রাণ।’
×