‘গোলাপ তোমার মর্মে পশেছে ব্যাধি’-‘ঙয, Rose, thou art sick’! মেটাফিজিক্যাল ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের বিখ্যাত একটি কবিতার লাইন। মর্মে বা মরমে ব্যাপারটি ঠিক কী সে বিষয়টি একটু বোঝার চেষ্টা করা দরকার। মর্মের একটি আপাত অর্থ হতে পারে হৃদয়। তবে কোন অবস্থাতেই হৃদ্পি- বা হৃৎপি- নয়। অনেকে প্রায়ই হৃৎপি-ের সঙ্গে হৃদয়কে গুলিয়ে ফেলেন। প্রকৃতপক্ষে হৃদয় শব্দটি খুব বেশি অন্তঃকরণ, চিত্ত, মনসহ বৃহৎ অর্থে বক্ষ, বুক বা বক্ষঃস্থল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে হৃৎপি- শুধুই একটি যন্ত্রবিশেষ, ইংরেজিতে যাকে বলে হার্ট। অন্যদিকে মর্ম শব্দটি কোমল ধ্বনি বিধায় কবিতা ও পদ্যে বেশি ব্যবহৃত হলেও, এটি মূলত হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। চিত্ত, মন, অন্তঃকরণ ইত্যাদির সমন্বয় ও সহাবস্থান। আমরা যখন বলি, ‘সই কে বা শুনাইল শ্যামনাম, কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ’Ñতখন প্রকৃতপক্ষে আমাদের হৃৎপি- আন্দোলিত হয় না; বরং আকুল-ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে হৃদয়মন। শ্রুতিযন্ত্র কানের ভেতর দিয়ে হার্টে নয়, বরং মস্তিষ্কে প্রবেশ করে অনুরণন তোলে আমাদের মর্মে। আরও একটু সহজ করে বলি, আমরা যখন দৈনন্দিন জীবনেও মর্মপীড়া বা মনোবেদনার কথা বলি, তখন তা কিন্তু কখনই হৃদ্বৈকল্যের কথা প্রকাশ করে না; বরং তা বড় বেশি হৃদয়বেদনা, মানসিক দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকেই বুঝিয়ে থাকে। কবি নজরুল ইসলাম মনোগ্রাহী কথা ও সুরে যখন বলেন, ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়’Ñতখন তিনি ঠিক হৃদ্যন্ত্র বা বক্ষপিঞ্জরের কথা বলেন না; বরং বলেন মস্তিষ্ক কর্তৃক সতত ক্রিয়াশীল হৃদয়ানুভূতির কথা। যাক, মর্ম বা হৃদয় বা হৃৎপি- নিয়ে অনেক তো কচকচি হলো। বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের সঙ্গে বোধকরি সবাই পরিচিত। ল্যানসেট বলছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান ১০টি কারণের শীর্ষে রয়েছে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। ২০১৩ সালের হিসেবে দেখা যায়, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দেশে প্রতিবছর মারা যায় এক লাখ ৭৮ হাজার। দ্বিতীয় স্থানে আছে স্কিমিক হার্ট ডিজিজ বা হৃদ্রোগ, প্রতি বছর এক লাখ ৬ হাজার। তৃতীয় ও পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অসুখে মৃত্যুর হার এর তুলনায় অর্ধেকেরও অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এ্যান্ড ইভালুয়েশন বিশ্বের ১৮৮টি দেশের রোগ ও মৃত্যুর তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছে। এ গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। তাতে বাংলাদেশের ১৯৯০ ও ২০১৩ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হৃদ্রোগে ৪০০ শতাংশ, ডায়াবেটিসে ২০০ শতাংশ, স্ট্রোকে ২০০ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। অন্যদিকে ডায়রিয়া বা উদরাময়ে ৯১ শতাংশ এবং নবজাতকের জন্ম জটিলতার কারণে ৭৯ শতাংশ মৃত্যু কমেছে। পরিবর্তনের এই কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে অসংক্রামক ব্যাধির উৎপাতÑ যেমন হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি। দ্রুত নগরায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জীবনযাপনের টানাপোড়েন ও জটিলতা। খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল ইত্যাদির পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বা টেনশন বেড়েছে অনেক। ফলে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ছে। বর্তমান বিশ্বে হৃদ্রোগ সম্ভবত পয়লা নম্বরের হন্তারক ব্যাধি। হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের বোধকরি একটি সম্পর্ক আছে। তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইপারটেনশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর প্রয়াত এসজিএম চৌধুরীর কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর প্রয়াত ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মতোই তিনি উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মহতী উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের উদ্যোগে সম্প্রতি তিন দিনব্যাপী পঞ্চম আন্তর্জাতিক কার্ডিওলজি ও কার্ডিয়াক সার্জারি এবং তৃতীয় ঢাকা লাইভ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো রাজধানীতে। এতে বাংলাদেশে হৃদ্রোগ, এর কারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও চিকিৎসাসহ নিরাময়ের পাশাপাশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, শল্য চিকিৎসা ও ওষুধবিষুধ সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্যাদির বিশ্লেষণ ও আদানপ্রদান করা হয়। এটিই বোধকরি এ জাতীয় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নগদ প্রাপ্তি ও সুফল। তদুপরি চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে ঢাকা লাইভের পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া প্রেজেনটেশন ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শেরও ব্যবস্থা থাকেÑকয়েক বছর আগে যা চিন্তা করাও যেত না। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বর্তমানে দেশে অনেক জটিল হৃদ্রোগের যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যয় অত্যধিক স্বীকার করেও বলতেই হয় যে, বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার তুলনায় সেটা অনেক কম।
এবারে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পর্কে দু’একটি কথা বলে শেষ করব প্রসঙ্গটি। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ফারজানা ব্রাউনিয়া বোধকরি যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে হৃদ্রোগ ও হৃদয়ঘটিত অসুখ-বিসুখের প্রসঙ্গটি গুলিয়ে ফেললেন অযথা কৌতুক করতে গিয়ে। করোনারি এনজিওপ্লাস্টি-কে বললেন এনজিওপ্লাস্টিক; আর এ ধরনের সার্জারিকে বললেন প্লাস্টিক সার্জারি। এ রকম একটি আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা বোধকরি টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন উপস্থাপক দিয়ে করাই ভাল। চিকিৎসকদের মধ্য থেকেই কেউ এটি করতে পারতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শীর্ষক সাধনার উপস্থাপনা যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে ফুটে উঠতে পারল না। কেন যে তারা মাল্টিমিডিয়া তথা প্রযুক্তির আরও সাহায্য-সহযোগিতা নিল না সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, ঠিক বোধগম্য হলো না। সব শেষে একটা কথা না বললেই নয়। ল্যাবএইডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডা. এএম শামীমের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক এই কার্ডিওলজি ও কার্ডিয়াক সার্জারিবিষয়ক সেমিনারের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করে আসছেন দেশের একজন বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ও সুলেখক ডা. বরেন চক্রবর্তী। আমরা জানি, এ রকম একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করতে কী কঠোর পরিশ্রম, সর্বোপরি আন্তরিক হতে হয়। অথচ আগাগোড়া আয়োজনের কোথাও তিনি প্রায় নেই বললেই চলে। যে দেশে প্রায় সবাই নিজের ঢাক নিজে পেটায় এবং অনেক ক্ষেত্রে শুধু চামড়া নয়, ঢাকই ভেঙ্গে ফেলে, সেখানে এটি ব্যতিক্রম বৈকি। তবে সব কথার শেষ কথা ও সার কথা হলো, রোগাক্রান্ত হওয়ার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ সর্বদাই উত্তম। হৃদ্রোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ একজন আপাত সুস্থ সবল মানুষকেও ঠিক কখন কোথায় আক্রমণ করবে, তার নিশ্চিত নিদান তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও দিতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা চালাতে হবে। চল্লিশের পর প্রায় নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াসহ ব্লাডসুগার, রক্তচাপ, কোলস্টেরল ইত্যাদি মনিটর করতে হবে। ধূমপান পরিহার করতে হবে সর্বতোভাবে। কোন মাদক বা নেশা নৈব নৈব চ। খাদ্যতালিকা থেকে রেডমিট অর্থাৎ গরু ও খাসির মাংস, ডিম, চর্বি, মাখন, ডালডা, ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড, মিষ্টি, কোমল পানীয় ইত্যাদি যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে অথবা কমিয়ে দিতে হবে। চা-কফি খেতে হবে চিনি ছাড়া। কায়িক পরিশ্রমসহ সম্ভব হলে নিয়মিত দৌড়ানো, নিদেনপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। অবৈধ সম্পর্ক পরিত্যাগ করে নিয়মিত দাম্পত্য সুখ-শান্তি উপভোগ করা আবশ্যক। প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। কর্মস্থলে ও সংসারে যথাসম্ভব দুশ্চিন্তা ও টেনশনমুক্ত থাকতে হবে। এর জন্য নিয়মিত কর্মসম্পাদন করা আবশ্যক। সর্বোপরি প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় হাসার অভ্যাস করতে হবে। মনে রাখা দরকার, হাসি রোগমুক্ত থাকার মহৌষধ। তবে মনে রাখবেন, এ সবই হাতুড়ে দাওয়াই। এ স্বাস্থ্যবটিকা হৃদ্রোগের মতো রোগনির্ণয় গোছের কিছু নয়।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: