ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাহলুল মজনুন চুন্নু

আবদুর রাজ্জাক যে ধ্রুবপদ দিয়েছো বাঁধি

প্রকাশিত: ০৩:০৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

আবদুর রাজ্জাক যে ধ্রুবপদ দিয়েছো বাঁধি

অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে এই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবদুর রাজ্জাক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। আবদুর রাজ্জাক, ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যথা শির’। আর সেই চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম তারই প্রেরণায়। কখনও শিশুর মতো, কখনও পিতার মতো, কখনও ভ্রাতা, কখনও বন্ধুর মতো থেকেছেন তিনি। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি আজীবন দেখেছেন এবং আমাদের মধ্যে তা সঞ্চারিতও করেছেন। ব্যক্তিত্বে, রুচিবোধে, সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়, সৌজন্যে এবং উদারতায় আবদুর রাজ্জাক এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। এক জীবনে দিয়েছেন যা, আদর্শ হয়ে তা চিরজাগরূক। বৃহত্তর পরিধিতে দেশ, সমাজের কথা ভেবেছেন এবং দেশ ও সমাজের উন্নতির জন্য কাজও করেছেন। জনগণের নেতা হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে পেতেছিলেন নিজস্ব আসন। মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থার স্থল ছিলেন। ইতিহাসের খেরো খাতায় স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে আবদুর রাজ্জাকের অবদান। রাষ্ট্র ও সমাজে অন্যায়, অনিয়ম, বৈষম্য ও শোষণ তাঁকে প্রতিবাদী হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন দেশে পথ চলা শুরু করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই পথে তিনি সংগঠিত করেছিলেন সাংগঠনিকভাবে দলকে। কিন্তু সব রক্ষা হয়নি। দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা খুনীর দল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কারাগারে আটকে রাখে টানা ২৭ মাস। কারাগারে থেকেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষা তাঁকে দুঃসাহসী করেছিল। নিশঙ্ক চিত্তে তিনি শত নির্যাতন, শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেছেন। জেলখানায় বসেও দল চালাতেন। তাঁরই নির্দেশে নেয়া হয়েছিল দল পরিচালনার নানা কর্মপরিকল্পনা। পঁচাত্তর-পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সে সময় রাজপথের প্রতিবাদী মিছিলের বাইরে ছাত্রদের সংগঠিত করতে হয়েছে আর কারাগার হতে তিনিই তা পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তাঁকে কাবু করা যায়নি। সুবিধাভোগী বা সুযোগসন্ধানী হওয়ার অভিলাষের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আমৃত্যু দেখি তাই আদর্শবান, নীতিপরায়ণ, নিষ্ঠাবান হিসেবেই তিনি ছিলেন নিবেদিত। সামরিক জান্তাদের শাসন-শোষণ-নিপীড়নে যখন কর্মীরা অসহায়, তখন জেল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন এবং দেখাতেন। অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার রাজনীতিক হিসেবে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন সাম্প্রদায়িকতাকে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহছায়ায় যে কয়জন কীর্তিমান স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে আমৃত্যু নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবদুর রাজ্জাক তাঁদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর ¯েœহভাজন ছিলেন শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্ন পূরণে ছিলেন শীর্ষযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু তাঁকে এতই বিশ্বাস করতেন যে, বাকশাল গঠনের পর সংগঠনের তিন সেক্রেটারির অন্যতম সেক্রেটারি করেছিলেন আবদুর রাজ্জাককে। অপর দু’জন ছিলেন মরহুম জিল্লুর রহমান ও মরহুম শেখ ফজলুল হক মণি। আবদুর রাজ্জাক সবসময় বলতেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর একজন শিষ্য, এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।’ ১৯৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে সারাদেশে জনপ্রিয় করতে সীমাহীন পরিশ্রম করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে কারাগারেও যেতে হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুসহ আবদুর রাজ্জাককে মুক্ত করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। অসম্ভব মেধাবী ও নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় এই নেতা দু’বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তার আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সহ-সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে জারি হয়েছিল হুলিয়া। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের একাংশ পর্যন্ত ছিলেন জেলে। ১৯৬৩ হতে ’৬৫ পর্যন্ত ছিলেন ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক। দেশের নেতাকর্মীরা যেমন তাঁকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন, তিনিও তেমনি নেতাকর্মীদের বুকে টেনে নিতেন। সুখে-দুঃখে সব সময় তাদের পাশে থাকতেন। অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। পঁচাত্তরে কারাগার জীবনেও ছিলেন সংগঠনকে সংগঠিত করার প্রক্রিয়ায় সচল। ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে জেল থেকে বেরুনোর পর থেকে দলকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তখন তিনি অসুস্থ। পিজি হাসপাতালে ছিলেন চিকিৎসাধীন আর সে সময় তাঁর সান্নিধ্য ও অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ ঘটে। এ সময় তিনি বিপর্যস্ত ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার পরিকল্পনা নেন। সে অনুযায়ী সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তারই নির্দেশনায় সারাদেশে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত হই। সে সময় সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ছাত্রনেতাদের প্রলোভিত করে তার দলে ভেড়াতে সক্রিয় ছিলেন। আবদুর রাজ্জাক কঠোর হুঁশিয়ারি জারি করেছিলেন, ছাত্রলীগের কোন নেতাকর্মী যেন কোন লোভের কাছে মাথানত না করে। আদর্শচ্যূত যাতে না হয় কেউ। সেজন্য ‘টিমওয়ার্ক’ চালু করেছিলেন। তারই নির্দেশনায় গতি পেয়ে ছাত্রলীগ সারাদেশে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। রাজনীতির মাঠ কাঁপানো, সারাদেশ চষে বেড়ানো ছিল তাঁর কাজের পরিধি। তাঁর ভরাট কণ্ঠের তেজ জনসভার শ্রোতার কাছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিভাত হতো। জাতীয় সংসদেও যুক্তিসহকারে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে ওবায়দুল কাদেরকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে পঁচাত্তর-পরবর্তী ছাত্রলীগের কমিটি হয়। বিপর্যস্ত সংগঠনকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য ব্যাপক শ্রম দিতে হয়েছে। সব জায়গায় সমান সাড়া পাওয়া যায়নি। পঁচাত্তর-পূর্ব অনেক ছাত্রলীগ নেতা সংগঠনচ্যুত শুধু নয়, সামরিক জান্তার সহযোগীতে পরিণত হন আবার শাসক দলের লোকজনও সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে গোলমাল তৈরি করত। প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোর হামলা-মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে দৃঢ় পদক্ষেপে। জেল থেকে বেরিয়ে আবদুর রাজ্জাক সচেষ্ট ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সক্রিয় করে সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করে তুলতে। ১৯৭৭ সালে জান্তাশাসক রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চালু করে, যাতে ছাত্র সংগঠনকে মূল দলের অঙ্গ সংগঠন করা বাধ্যতামূলক করা হয় অথচ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই ছিল স্বাধীন সংগঠন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ভূমিকা পালন করত। ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রায় সেদিন আবদুর রাজ্জাক সীমাহীন পরিশ্রম করেছেন আর এই কাজ করতে যেয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যা অটুট ছিল। এক সময়কার তুখোড় ছাত্রনেতা কাজী জাফর আহমেদ আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে লিখেছেন, “’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী শিক্ষা আন্দোলন ও ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সর্বোপরি সুমহান মুক্তিযুদ্ধে আবদুর রাজ্জাকের রয়েছে ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল অবদান। ইতিহাসের এই সত্যকে যারা অস্বীকার করবেন তাঁরা অবশ্যই জ্ঞানপাপী। যৌবনে আবদুর রাজ্জাক সুঠামদেহ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি কারাগারে নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। একসময় তিনি কুস্তিগীরও ছিলেন। কারাজীবন থেকেই রাজ্জাককে আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। তাঁর মতো সৎ, দেশপ্রেমিক, অমায়িক, নির্লোভ এবং আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত ব্যক্তিত্ব খুব কমই দেখেছি। কারাগারে এবং কারাগারের বাইরে দল-মত, নির্বিশেষে রাজ্জাক সবার ¯েœহ-ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র।” তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালে ১ আগস্ট শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ইমামউদ্দিন এবং মাতার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা। আবদুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবনের শুরু পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫-৬৭ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পরপর দু’বার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত পরপর দুবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১-২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রয়েছে তাঁর। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়া এই বীরযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষকও ছিলেন। আবদুর রাজ্জাক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৯৬ পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সই হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা এবং সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আজীবন লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি শান্তি আন্দোলনেও অবদান রেখেছেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেরেবাংলা জাতীয় পুরস্কার, নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন এই বর্ষীয়ান নেতা। ২৩ ডিসেম্বর ২০১১। লন্ডনে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর ঢাকায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙ্গে পড়ি শোকে। কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। পিতার মতো বটবৃক্ষের মতো ¯েœহ, ছায়া, মমতা এবং জীবন চলার দিকনির্দেশনা দাতা আর নেই, এমনটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল সতীর্থসহ আমারও। তিনি একসময় শরীরচর্চা করতেন ছাত্রজীবনে, পরবর্তীকালে জেল, জুলুম আর প্রচ- কায়িক শ্রমে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। নানা অসুখ-বিসুখ এসে বাসা বাঁধে। সামরিক জান্তা শাসনকালে বহুদিন থাকতে হয়েছে আত্মগোপনে। খাবার-দাবারের অনিয়মে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। নিজের দিকে ফিরে তাকানোর অবসর খুব কমই ছিল। সংসার যাপনে বিঘœ ঘটত ওই সময়গুলোতে। অসুস্থ মানুষটি শেষ শয্যায় শায়িত হাসপাতালে। কিন্তু ভুলে যাননি, ¯েœহধন্যদের। ফোন করে কথা বলেছেন। দেশ, জাতি, রাজনীতি নিয়ে ভাবনার কথাও বলেছেন। সহযোদ্ধাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। অনেক কর্মীর প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। বেঁচে থাকার উদগ্র আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চেয়েছেন। চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে বেশি মনোনিবেশ করতে। ফোনে যখন কথা বলতেন, বুঝতে পারতাম অশ্রু সংবরণ করতে পারছেন না। চিকিৎসকরাও বেশি কথা বলা বারণ করেছিলেন। ছাত্রজীবনে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আবদুর রাজ্জাক কুস্তিতে ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনিয়ম ও উদাসীনতা তাকে ধীরে ধীরে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। পিতার মৃত্যু যেমন বুকভরে শূন্যতা তৈরি করে সন্তানের, অভিভাবক অগ্রজ রাজ্জাক ভাইয়ের তিরোধান অনুরূপ শূন্যতার পরিম-ল ও আবহ তৈরি করেছে। মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে অজয় অমর স্মৃতি। লেখক : সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×