ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কনভিক্টেড ক্রিমিনাল তারেকের ফলাও প্রচারে শত ধিক্কার

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

কনভিক্টেড ক্রিমিনাল তারেকের ফলাও প্রচারে শত ধিক্কার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তারেক রহমান উন্মাদের মতো কথা বলছে। সে একজন কনভিক্টেড ক্রিমিনাল। বিদেশে বসে সে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করছে। সেটাও আবার ফলাও করে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে মিডিয়ায়। আমি এর শত ধিক্কার জানাই। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বিতর্কিত বক্তব্য প্রসঙ্গে এ কথা বলেন অমর একুশের কালজয়ী গানের স্রষ্টা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। শনিবার এই প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিককে নিয়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’ শীর্ষক আড্ডার আয়োজন করে। পিআইবির সেমিনার কক্ষে প্রাণবন্ত এ দীর্ঘ আড্ডায় নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন গাফ্ফার চৌধুরী। উঠে আসে তাঁর শৈশব-কৈশোরের কথা, পেশাগত জীবনের কাহিনী, তাঁর সময়ের সাংবাদিকতার নানা দিক, চলমান সময়ের সাংবাদিকতার মূল্যায়ন, দেশে নারী সাংবাদিকতার অবস্থা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত তাঁর নাটক ও ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়। নিজেদের কথার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীর। বৈঠকী ঢংয়ের এ আড্ডার আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবেদ খান, সকালের খবর সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ। শুরুতেই শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যান গাফ্ফার চৌধুরী। বলেন, আমার কোন বর্ণাঢ্য শৈশব নেই। আছে শুধু স্মৃতিবিজড়িত শৈশব। ব্রিটিশ আমলে বরিশালের উলানিয়ার এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে আমার জন্ম। পরিবারেই ছিল রাজনৈতিক আবহ। বাবা ওই অঞ্চলের কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে কারাবরণও করেছিলেন। অন্যদিকে আবার চাচাতো ভাই মুসলিম লীগ করতেন। ফলে উদার ও রক্ষণশীলতার মিশ্রতায় বেড়ে উঠেছি। পাশাপাশি তখনকার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আমাকে মানসিক বিকাশে সহায়তা করেছে। সাহিত্যের সঙ্গে নিজের সংযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ক্লাস থ্রি থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়তে হয়েছে। সে কারণেই সাহিত্যবোধ ও ভাষার চর্চাটা ভাল হয়েছিল। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনকার নিরপেক্ষ পত্রিকায় যতটা সত্য লেখা হয় তখনকার দলীয় পত্রিকা আজাদও অতটা দলীয় ছিল না। তখনকার সাংবাদিকতা ছিল পাঠককে সংবাদ জানানো। আর এখনকার সংবাদপত্রের কাজ হচ্ছে নিজেদের মতামত পাঠককে গেলানো। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আওয়ামী লীগ করতেন, জহুর হোসেন চৌধুরী ন্যাপ করতেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সাংবাদিকরা নিরপেক্ষতার ভান করেননি। তাঁরা ব্যক্তি জীবনে সেটা করেছেন সেটা প্রকাশ্য ছিল। মানিক মিয়া আওয়ামী লীগ করলেও ইত্তেফাকে কাজ করতেন কমিউনিস্টরা। আজকাল টকশোতে যেভাবে গালিগালাজ করা হয়, যে ভাষায় কথা বলা হয় আমাদের সময় এ ধরনের পরিস্থিতি ছিল না। তখনও যে সংবাদ টুইস্ট করা হতো না তা নয়, তবে এখন সংবাদ টুইস্ট করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যেটা বলা হয়নি সেটাও লিখে দেয়া হয়। এ সময় গাফ্্ফার চৌধুরী তার নিজের একটি বক্তব্যের উদাহরণ টেনে বলেন, আমি একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলাম তারেক রহমান শাহীন স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়েছিল। তার অনেকগুলো কারণের একটি ছিল মেয়েদের টিজ করা। কিন্তু মিডিয়াতে প্রকাশিত হলো আমি নাকি বলেছি তারেক মেয়েদের কিস করত। এর জন্য আমার বিরুদ্ধে বগুড়ায় মামলাও হয়। তবে আদালতে মামলা টেকেনি। তিনি বলেন, এখন সম্পাদকদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে একে অপরের মুখ দেখেন না। অন্যকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, এখন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় না। সাগর-রুনির হত্যাকা- নিয়ে সাংবাদিকরা সরকারের দিকে অভিযোগ ছুড়ছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করছে না। ভাষাগত দৈন্যও প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। সাংবাদিকরা এখন বিভিন্ন শিবিরের অনুগ্রহপ্রার্থী। যদিও এখনকার সাংবাদিকতা প্রযুক্তিসহ নানা কারণে অনেক উন্নত হয়েছে। একটি পত্রিকা পড়লে দুনিয়ার সব খবর পাওয়া যায়। আমাদের সময়ে নারী সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া না গেলেও এখন অনেক নারী যুক্ত হয়েছে সাংবাদিকতায়। নিজের কলাম লেখা প্রসঙ্গে বলেন, একসময় আমি অনেকগুলো পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয় লিখতাম। এর মাঝে দেশে আসার পর একজন সম্পাদক বললেন, তাঁর পত্রিকায় লিখলে আমাকে দ্বিগুণ সম্মানী দেয়া হবে। আমিও প্রয়োজনের তাগিদে ওই পত্রিকায় লেখা শুরু করলাম। এর কিছুদিন পর আমার সম্মানী আরও বাড়িয়ে দেয়া হলো। এরপর জানানো হলো আমাকে পাউন্ডের হিসাবে অর্থ প্রদান করা হবে। তবে ওই সম্পাদক আবদার করলেন, আমাকে একটু অন্যভাবে লিখতে হবে। এ ঘটনার পর আমি ঘোষণা দিয়ে ওই পত্রিকায় লেখা বন্ধ করে দেই। ব্যক্তিজীবনে আমি অসৎ হলেও সাংবাদিকতা জীবনে কখনই নৈতিকতার বাইরে যাইনি। কিন্তু ওই সম্পাদকের সেই পত্রিকাটি এখন পাঠককে নিরপেক্ষ সংবাদ ও সাংবাদিকতার জ্ঞান দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণা প্রসঙ্গে গাফ্্ফার চৌধুরী বলেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ৬ দফা সমর্থন করেননি। তিনি ইত্তেফাকে ৬ দফার সংবাদ ছাপেননি। আমি প্রথম আওয়াজ পত্রিকায় ৬ দফা ছাপি। পরে ভুল বুঝতে পেরে মানিক মিয়া ইত্তেফাকে ৬ দফার সংবাদ ছাপালেন। সাংবাদিকতার আদর্শিকতা প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের সময়ে এই পেশায় আদর্শগত ভিত্তি ছিল; এখন আছে বাণিজ্যিক ভিত্তি। সেই সময় বেতন পাওয়ার নির্দিষ্ট দিন ছিল না। এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নেন মানিক মিয়া। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ধার-দেনা করে হলেও মাসে ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করবেন। নারী সাংবাদিকতা বিষয়ে গাফ্্ফার চৌধুরী বলেন, আমাদেরকে নারী হয়ে সাংবাদিকতা করতে হয়েছিল। বেগম পত্রিকা যখন বের হয় তখন সম্পাদক পাওয়া যাচ্ছিল না। কবি সুফিয়া কামালকে সম্পাদক করা হয়। ওই পত্রিকায় আমাদের লিখতে হয়েছে। পরে সাংবাদিকতায় আসেন লায়লা সামাদ। তাঁকে নানা অপবাধ গুঞ্জন শুনতে হয়েছে। তিনি রিক্সার হুড তুলতেন না, কপালে টিপ পরতেনÑ এটা অনেকে মেনে নিতে পারত না। টকশো প্রসঙ্গে বলেন, এ জাতীয় আলোচনা অনুষ্ঠানগুলো খুবই নিম্নমানের। এখানে পরস্পরকে গালাগালি করা হয়, মন গড়া কথা বলা হয়। নিজের সাংবাদিকতা শেখা প্রসঙ্গে বলেন, মওলানা আকরম খাঁ, জহুর হোসেন চৌধুরীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেই অর্থে এখনকার সাংবাদিকরা জ্ঞানী হলেও আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। মজা করে তিনি বলেন, বলতে গেলে আমরা খালেদা জিয়ার মতো স্বশিক্ষিত সাংবাদিক ছিলাম। এখন তো সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের সময় তেমনটা ছিল না। সম্পাদক প্রসঙ্গে বলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করতে হয় সাংবাদিককে। পত্রিকার মালিকরা এখন আর সম্পাদক নয় ভাল ম্যানেজার চায়। তাই ভাল ব্যবস্থাপক না হলে টেকা যায় না। এমন অবস্থা চললে পত্রিকায় একসময় সম্পাদকীয়র পরিবর্তে ব্যবস্থাপকীয় ছাপা হবে। দুই-একজন ছাড়া আদর্শিক সম্পাদক এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্পাদকীয় প্রজাতি একদিন হয়তো ডাইনোসরীয় প্রজাতিতে পরিণত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ, এখন টাকা হলেই সম্পাদক হওয়া যায়। কোন যোগ্যতার দরকার হয় না। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সম্পাদক হওয়ার বিষয়ে কার্যকর আইন প্রণয়ন করা উচিত। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও বলেন, আগে পত্রিকার সম্পাদকরা ছিলেন রাজনীতিক। আর এখন ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন সম্পাদক। কালো টাকা লগ্নি করে পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করছে। এ কারণেই মাহমুদুর রহমানের মতো লোকও সম্পাদক হতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক নির্মাণ ও ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা যেন সর্বগ্রাসী ভীরুতায় আক্রান্ত হয়েছি। ‘পলাশী থেকে ধানম-ি’ নাটকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটি করার জন্য আমি প্রথম আলী যাকেরকে প্রস্তাব দিলাম। অনেক অজুহাত দিয়ে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেন না। এরপর প্রস্তাব দিলাম তারিক আনাম খানকে। তিনি অভিনয় করতে রাজি হলেও শর্ত জুড়ে দিলেন যে, নাটকটি থেকে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বাদ দিতে হবে। আসাদুজ্জামান নূরকে পা-ুলিপি পাঠালে জানালেন, তিনি আসলে পারফরমার নাট্যকার নন। তাই এটা তাঁর পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটি করার জন্য রাজি হলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন আবার শেখ পরিবার থেকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক দিয়ে কেন বঙ্গবন্ধুর চরিত্র রূপায়ন করা হলো। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা নাটকটি দেখে এর প্রশংসা করলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথমে হিসাব করেছিলাম ১৬ কোটি টাকার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছবি করা সম্ভব। পরবর্তীতে বুঝলাম আসলে ছবিটি তৈরি করতে হলে প্রয়োজন ১০০ কোটি টাকা। এ নিয়ে ভারতের অভিনয়শিল্পী ওম পুরী ও জয়া ভাদুড়ির সঙ্গে কথা বললাম। তাঁদের সূত্রে অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটি করার প্রস্তাব দিলাম। অমিতাভ রাজি হলেন। তবে ছয় মাসের সময় চাইলেন পা-ুলিপি পড়ে দেখার জন্য। সেই সঙ্গে অগ্রিম সম্মানীও দাবি করলেন। এদিকে আমার চেষ্টা চলতে থাকল। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ দিতে দেশের অনেক শিল্পপতিই রাজি হলেন। তবে তাঁদের প্রত্যেকেই ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের শর্ত জুড়ে দিলেন। কেউ চাইলেন তার ছেলের খুনের মামলা প্রত্যাহার করিয়ে দিতে, আবার কেউ ভূমি দখল সংক্রান্ত তদবিরের কথা বললেন। এতসব কিছুর পর সর্বশেষ ভারতের খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি ভীষণ আগ্রহী হয়েছেন। এমনকি প্রযোজকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ যোগাড় করার বিষয়েও কথা বলেছেন। এখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। উত্তম কুমারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৭৪ সালে স্ত্রী তখন কলকাতায়। এর আগে থেকেই উৎপল দত্তের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তাঁর সুবাদে সাক্ষাত হয় মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে। সে সময় তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার একটি ছবিতে অভিনয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। পরবর্তীতে এ কথা বঙ্গবন্ধুকে জানানোর পর তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে উত্তম কুমারকে দিয়ে ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্ক উল্লেখ করে বলেন, ব্রিটিশ ফিল্ম এ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হলে এই অভিনেত্রী বললেন, একজন বাঙালীর হাত থেকে পুরস্কার নেবেন। সেই সূত্রে এই প্রখ্যাত অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এখনও সেই সম্পর্ক আছে। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর যুবক বয়সের চরিত্রে সাইফ আলী খানের অভিনয় প্রসঙ্গে প্রস্তাব দিলে বলেন ও বিনা পয়সায় এই ছবিতে অভিনয় করবে।
×