ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

এক উন্মাদের অলীক উচ্চারণ

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

এক উন্মাদের অলীক উচ্চারণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আবারও তারেক রহমানের ঘৃণ্য কটূক্তি করার ঔদ্ধত্য লক্ষ্য করেছে দেশবাসী। চিকিৎসার নামে দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর লন্ডনে স্বেচ্ছায় বসবাসরত তারেক রহমানের কুরুচিপূর্ণ ও ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য দেশের সর্বত্র প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। তারেকের বেপরোয়া ও বেসামাল উক্তিতে সৃষ্ট সমালোচনার ঢেউ দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছাড়িয়ে পড়ছে। তার দুঃসাহস সকল সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বপ্নদ্রষ্টা সম্পর্কে অর্ধশিক্ষিত অর্বাচীনের অশালীন ও অশোভন বক্তব্য এদেশের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে পূর্ব লন্ডনের এ্যার্টিয়াম ব্যাংকোয়েট হলে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তারেক রহমান ইতিহাসের চরম বিকৃতি ঘটিয়ে জাজ্বল্য মিথ্যাচার ও নির্লজ্জ বিষোদগার করে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার ও শখের বন্দী’ বলার দুঃসাহস দেখিয়েছে। কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এক সভায় নিজের বাবা জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বলে দাবি করে তারেক। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ বলা হয়। গত আগস্ট মাসে এক সভায় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে বাংলাদেশের অভিশাপ এবং আওয়ামী লীগকে কুলাঙ্গারের দল বলে অভিহিত কওে তারেক। গত ৭ নবেম্বর এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকবন্ধু’ বলে অভিহিত করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সব শ্রেণীর মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ, গণমিছিল ও মানববন্ধনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে চরম অবমাননাকর ও অশালীন মন্তব্য করার বিরুদ্ধে ক্ষোভে-বিক্ষোভ হয়েছে। সর্বশ্রদ্ধেয় কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক এবং অমর একুশের কালজয়ী গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তারেক রহমানের স্পর্ধা সম্পর্কে যে যথার্থ মন্তব্য করেছেন তারপর আমার মতো এক সাংবাদিকের আর কিছু বলার থাকে না। তারপরও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রথিতযশা এই সাংবাদিকের সঠিক মন্তব্যের সমর্থনে কিছু বলার চেষ্টা করা। গাফ্ফার ভাই বলেছেন, ‘তারেক রহমান একজন জীবন্ত উন্মাদ। সে পাগল হয়ে গেছে। পাগল না হলে বিলেতে বসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন ধরনের বক্তব্য দিত না। তাকে অর্ধউন্মাদ বললেও সম্মান করা হবে। এই উন্মাদ অবস্থাতেই তার শেষ পরিণতি ঘটবে।’ তিনি অবশ্য তারেক রহমানের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দেয়ারও আহ্বান জানান। ১৭ ডিসেম্বর বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অগ্রণী রিসার্চ নামের এক সংগঠন আয়োজিত ‘ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ৭ মার্চের তাৎপর্য’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। তারেক রহমান যে ন্যক্কারজনক মিথ্যাচার ও বেসামাল কথা বলছেন তা নিয়ে শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক ও নেতাকর্মীদের মধ্যেই নয়, খোদ বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও ক্ষোভ-অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বুঝতে একবারেই অক্ষম যে, তাদের নেতা তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেন একের পর এক এমন সব উদ্ভট মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করছে। বিষয়টি নিয়ে তারা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকটি মামলায় তারেকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকায় সে এখন দেশে ফিরতেও সাহস পাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে লবিং করে আশু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর তেমন কোন চাপও সৃষ্টি করতে পারছে না বিএনপি। এমনকি সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে দলটির নেতা-কর্মীরা আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারছে না। অনেকেই মনে করছেন, সে কারণেই তারেক রহমানসহ দলের কিছু নেতা আবোল-তাবোল কথাবার্তা ও বেসামাল উক্তি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এ ধরনের কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসও যে বিফলে যাবে সে সত্যটিও বোঝানোর মতো কেউ দলে আছেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে ধারে-কাছে আছে অনেক তোষামোদকারী যারা খালেদা জিয়া এবং তার গুণধর পুত্র তারেক রহমানের মন যুগিয়ে চলার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে বিএনপি শাসনামলের রমরমা দিনে ‘হাওয়া ভবন’-এ তারেক-ঘনিষ্ঠ বেশিরভাগ লোকই এখন বিদেশে ঠাঁই নিয়েছে। তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ। এদের মধ্যে অনেকেই তারেককে রাজনীতিতে তার সরব উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার ও আলোচনায় রাখার লক্ষ্যে বিদেশে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের নামে মাঝে-মধ্যে খালেদা জিয়ার বড় পুত্র দুর্নীতির বরপুত্রকে দিয়ে এসব অসত্য ও মিথ্যাচার করছে। ১৫ ডিসেম্বর রাতে লন্ডনে অনুষ্ঠিত সভায় তারেকের নির্লজ্জ বক্তব্য তার চাটুকার ও তোষামোদকারীদের ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তারেক রহমান এর আগেও লন্ডনের এক হোটেলে বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে। যেদিন তারেক রহমান লন্ডনে এ বক্তব্য দেয় ঠিক সেদিনই রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনাসভায় বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদেক হোসেন খোকাও তারেক রহমানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করে বক্তব্য রাখেন। মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত রেখে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াও জোরের সঙ্গেই বলেন, ‘জিয়াই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক।’ অনেকে মনে করেন বিএনপি বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছে তারই খেসারত দিতে হচ্ছে এখন এই দলটিকে। নানাভাবে নানারূপ হিসাব-নিকাশ করে তাদের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ভর করেছে চরম হতাশা। কথাটি তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পাকিস্তানপ্রেমে মশগুল খালেদা জিয়া পাকিস্তানের ঘৃণ্য গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং এদেশে তার রাজনীতির দোসর জামায়াতে ইসলামের ইশারায় বিএনপি ৫ জানুয়ারীর সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। বিএনপির প্রতি দুর্বল অনেকে এ কথাও বলে ফেলেন যে, নির্বাচন করলে বিএনপি হয়ত সরকার গঠন করার মতো আসন পেয়ে যেত। তাছাড়া, তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হতাশা এতটাই প্রবল যে, বার বার আন্দোলনের হুমকি দিয়েও তারা এখন সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে পারছে না। উপরন্তু, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন মামলায় ফেঁসে যাওয়ায় তারা এখন চারদিকে অন্ধকার দেখছেন এবং এজন্যই বিএনপির কথিত ‘দেশনেতা’ তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উন্মাদের মতো কথাবার্তা বলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে সংঘটিত কয়েক বছরের ঘটনা তখন শিশু তারেকের মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু বিএনপি নেত্রী ও মিথ্যাচারের মহারানী বেগম খালেদা জিয়ার তো বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বেগম জিয়াকে কি বলে তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সে সত্যটি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার চেয়ে আর কারোই ভাল জানার কথা নয়। তারেক রহমান তখন ছোট থাকলেও বড় হয়ে নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক ঘটনাটির আদ্যোপান্ত সব জানতে পেরেছে। তারপরও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন কুৎসিত কথা শুধু তার মানসিক দীনতাই প্রমাণ করে না, তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিচায়কও বটে। বাবা জিয়া জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তারেকের মা খালেদা জিয়ার সংসার রক্ষাকারী বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে ১৯৯৬ সালের কোন এক সময় সাভারে এক জনসভায় দম্ভভরে বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘কে জাতির পিতা, উনি তো বৈষম্য করেছেন।’ এ বিষয়ে আমি বিশদভাবে এই পত্রিকায়ই লিখেছিলাম। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে যাবে বলে আজ আর কিছু বলছি না। তবে বলতেই হচ্ছে, তারেক যোগ্য মাতার যোগ্য উত্তরসূরিই বটে। যে মহান ব্যক্তি এক পর্যায়ে ধমকের সুরে তাকে (খালেদা জিয়া) তার স্বামীর হাতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘এই জিয়া, এরপর আর যেন কিছু না শুনি।’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেই মহিলারই ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, তার ছেলের আর থাকে কী করে! তবে তারেককে শুধু এটুকুই বলব যে, রাজনীতি করার যখন ইচ্ছে আছে, তাহলে মিথ্যাচার বন্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তো নয়ই। তাই বলছি ধীরে বৎস, ধীরে। ২১ ডিসেম্বর পত্রিকায় দেখলাম অর্ধশিক্ষিত তারেক রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞ শিক্ষকের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের ‘অশালীন মন্তব্য ছেড়ে শালীন ভাষায় ইতিহাসের নিরিখে’ কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে। এই বক্তব্য প্রদানের পর সঙ্গত কারণেই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে তারেক রহমান লন্ডনে বসে বিগত কয়েক মাসে যে মিথ্যাচার ও বিষোদগার করেছে তা কতটা শালীন-শোভন ও ইতিহাসের নিরিখে হয়েছে? এই অর্বাচীনটি যে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাকার’ ও ‘পাকবন্ধু’ বলেছে তা কতটা শালীন হয়েছে, ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে? তার বক্তব্যে ইতিহাস বিকৃতির চরম প্রকাশ ঘটেছে। তারেকের বাবা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু তিনিও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোন খারাপ কিছু বলেননি, বরং সম্মানই প্রদর্শন করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে নিজেকে কখনই স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। তারেক সম্পর্কে মানুষ তাই বলে- ‘পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়।’ তাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারেকের উক্তি এক উন্মাদের উচ্চারণই মনে হচ্ছে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×