ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সুফল মিলছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ॥ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্য আয়ের পথে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

সুফল মিলছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ॥ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্য আয়ের পথে দেশ

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হিসেবে পাঁচটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। একটি এখনও চলমান রয়েছে। এসব পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর অনেকগুলো পূরণে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে সব পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্থনীতির মূল সূচক জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার গড় ৭৫ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। সেই অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির কারণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিতে কোন আঘাত এলেই সেটি অল্প সময়ের মধ্যে পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। এ কারণে অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো সফল হয়েছে। দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৯০ ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড় লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ দশমিক ৫০ শতাংশ। ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও চার শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ দশমিক ৭৩ শতাংশ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর পরের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও (১৯৮৫-১৯৯০) ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির কারণে সফলতা এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলেন, আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িতরা অবিরাম অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নানা সময়ে অর্থনৈতিক বাধা এলেও সেটি পুষিয়ে নিয়েছে অন্তর্নিহিত শক্তির কারণে। গত অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রানা প্লাজা ধসের কারণে অর্থনীতি থমকে গেলেও সেটি কয়েক মাসেই পুষিয়ে নিয়েছে। সামাজিক সূচকগুলোরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেয়ার সময়ে অর্থনীতিবিদরা পুরোটা না বুঝেই ব্যাপক সমালোচনা করেন। শুরু থেকেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না বলে দাবি করে। তবে সাম্প্রতিককালে গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সব জায়গায় ভাল করেছে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। সূত্র জানায়, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫)। এ সময়ে গড়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। সর্বশেষ হিসাব পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার ৮৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এর আগে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৯০-১৯৯৫) ৮৪ শতাংশ অর্জিত হয়। আর তার আগের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) ৭২ দশমিক ৮৬ শতাংশ অর্জন করে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, ক্রমেই দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ার কারণে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অনেকের মতে, অবাস্তব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আসলে ঠিক নয়। বর্তমানে অর্থনীতি যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তাতে কোন বড় বাধা না এলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্ভব। অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে নতুন নতুন খাত যুক্ত হয়েছে। চার নতুন সেবা খাতকে অর্থনীতিতে যুক্ত করা হয়েছে। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডেকোরেটর, নিরাপত্তা সেবা, নিয়োগ সেবা এবং পরিচ্ছন্নতা সেবা। এসব খাত থেকে জিডিপিতে প্রায় ৩৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা যুক্ত হবে এবং জিডিপি প্রায় শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০১৩’র প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এক দশকের ব্যবধানে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বড় ধরনের ঊলম্ফন হয়েছে। গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিটের ক্ষেত্রে ১১৮ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। এর ৭২ শতাংশই গ্রামভিত্তিক কুটির শিল্প, যা অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করছে। বিবিএস বলছে, শহরভিত্তিক ইউনিটগুলো অনেক বড়। সেই তুলনায় গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাখ লাখ ইউনিট গড়ে উঠেছে। যারা অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় এসব শিল্প ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়। এমন অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৫৮ লাখ ১৭ হাজার ৭২৪টি। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট শিল্প ইউনিটের ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ, পৌরসভায় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, উপজেলা পর্যায়ে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, অর্থনীতিতে গ্রাম বড় ভূমিকা পালন করছে এতে কোন সন্দেহ নেই। উৎপাদনশীলতার দিক বিবেচনায় কিছুটা কম হলেও কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। গ্রাম এলাকায় শিল্প ইউনিট গড়ে না উঠলে দেশের একটি বড় অংশ বেকার থাকত, যা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করত। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় গ্রামভিত্তিক শিল্প ইউনিটগুলোর ওপর নজর দেয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে বাজারের সঙ্গে গ্রামের শিল্প ইউনিটগুলোর সংযোগ গড়তে হবে। যাতে কাঁচামাল ও ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে, যা অর্থনীতিকে বড় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সূত্র জানায়, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা এই পর্যায়ে উন্নীত হতে তিনটি সূচকের মধ্যে একটি ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে, দ্বিতীয়টির প্রায় কাছাকাছি এবং তৃতীয়টিতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বল্পোন্নত দেশের দুর্নাম ঘুচছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে যে তিনটি সূচকের মানদ- বিবেচনা করা হয়, সেগুলোর মধ্যে মাথাপিছু মোট দেশজ আয় (জিএনআই) সূচকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার বা তার বেশি হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের সর্বশেষ হিসাব মতে জিএনআই এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার হয়েছে। অন্যদিকে সিডিপির ২০১২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৮-১০ এই তিন বছরে গড় (ব্যবহৃত সূত্র বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর অনুযায়ী) ৬৩৭ মার্কিন ডলার এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২ সালের হিসাবে মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৮৪০ মার্কিন ডলার। মানব সম্পদ সূচকে স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় মান ৬৬ বা তার বেশি। বাংলাদেশের বর্তমানে অবস্থান হচ্ছে ৬৫ দশমিক ৯৬। ২০১২ সালের সিডিপির পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী ছিল ৫৪ দশমিক ৭। অর্থনৈতিক সংকট সূচকে স্বল্পোন্নত থেকে বের হতে প্রয়োজনীয় মান ৩২ বা তার কম। কিন্তু বর্তমানে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কার্যক্রম চলছে। আশা করা হচ্ছে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে। তবে ২০১২ সালের সিডিপির পর্যালোচনায় বাংলাদেশের মান ছিল ৩২ দশমিক ৪। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, সরকারের একটি লক্ষ্যই রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া। আমি মনে করি এলডিসি তালিকা থেকে আমরা বেরুতে পারলেই সে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে। এর ফলে উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। স্বল্পোন্নতের তালিকায় থাকলে আমাদের উন্নয়ন অনেক পিছিয়ে যাবে। আমাদের অর্থনীতি যদি সবল হয় তাহলে এখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা যেসব সুবিধা পাচ্ছি সেসব সুবিধা না হলেও চলবে। যেমন ভারত, চীন এরা তো এলডিসিভুক্ত দেশ নয়, তারপরও এদের রফতানি প্রবৃদ্ধি তো অনেক বেশি। সেরকম বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসবে তখন আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
×