ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবন ॥ দরকার সমীক্ষা

প্রকাশিত: ০২:৫৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবন ॥ দরকার সমীক্ষা

সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে সুন্দরবন। গাছে গাছে ফার্নেস তেলের মাখামাখি। ঝোপঝাড়, মাটিতেও তেলের চাদর বিছানো। শ্যালা ও পশুর নদীর পানি তেলে-জলে একাকার। যে পানি জোয়ার-ভাটায় প্রবাহিত হচ্ছে খাল-বিলে। বন্যপ্রাণী, জলজ প্রাণীর জীবন নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। আর সংশয় বাড়িয়ে তুলছে নানা মুনির নানা মতামত, মতবাদে। সমীক্ষাহীন আতঙ্ক ছড়ানোর কাজও চলছে। কোন বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা ছাড়াই একেকজন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অবস্থান নিয়ে হরেক কিসিমের মন্তব্য করছেন। যে যার মতো করে, নিজস্ব ভাবনায় অপরের দোষত্রুটি, খুঁত শুধু খুঁজছেন না, অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টাও করছেন। এসব উদ্গীরিত বাক্য একত্রিত করলে কোন সারবস্তুর সারাংশ মেলে না। ক্ষয়ক্ষতি যে হয়েছে, সেটা তো সত্যি এবং বাস্তব। প্রায় দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে দুর্ঘটনার। আর এই সময়টাতে সঠিক পন্থা অবলম্বন করার বিষয়টি উপেক্ষা করে ঘটনার দায়দায়িত্ব কার ওপর বর্তায় তা নিয়ে তুলকালাম ভাষ্য চলছে। সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদ আশঙ্কামুক্ত কিংবা আশঙ্কামুক্ত নয়। আবার পর্যবেক্ষণকারীরা দাবি করছেন, সবকিছু আশঙ্কামুক্ত। ডলফিনসহ সব ধরনের জলজ ও বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের ওপর কি ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা নির্ধারণ করা হয়নি এখনও। বনবিভাগ কবে করবে, তা তারাই জানে। এক মন্ত্রণালয় দায়ী করছে অপর মন্ত্রণালয়কে। কার কত দায়ভার, সে নিয়ে সময়ক্ষেপণ আর যাই হোক মূল সমস্যার সমাধানে কাজে আসবে না। সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে গত ৯ ডিসেম্বর তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের আশঙ্কা, এই দুর্ঘটনার কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব পড়বে। দুর্ঘটনার পর কি করলে কি হতো, তা নিয়ে সুপরামর্শ দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। ট্যাঙ্কারডুবির ঘটনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, তেলের দূষণের কারণে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে কোন জলজপ্রাণী মারা যাওয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। পানিতে কোন ধরনের ‘গ্রিজ অয়েলের’ অস্তিত্বও মেলেনি। কমিটি অবশ্য বলছে, ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা জরুরী। পরিবেশবাদীরা বলছেন, সুন্দরবনের নদী-খালে যে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল, বর্তমানে তা দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিকর তেলের ধকল কাটিয়ে কবে প্রাণের স্পন্দন দেখা যাবে নদী-খালে, তা বলা দুরূহ। গাছপালা ও নদীতীরে মিশে থাকা তেল কচুরিপানায় জড়িয়ে ভাটিতে নামছে। বন ও পরিবেশমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, ঘটনায় সুন্দরবনের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। নৌযান চলাচলের জন্য দুটি নৌরুট করার কথা থাকলেও তা হয়নি। সুন্দরবনে কী ঘটেছে, ক্ষতির পরিমাণ কত, ভবিষ্যতে এর প্রভাব কি দাঁড়াবে তা নির্ধারণে প্রয়োজন সমীক্ষা ও গবেষণা। কারণ, যে হারে বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম ভাষ্য প্রদান করছেন, আতঙ্ক তৈরি করছেন তাতে সবাই বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন। তবে আশার কথা, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে জাতিসংঘের একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল এখন ঢাকায়। তারা ইউএনডিবির সহযোগিতায় সমীক্ষা কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। তারা তেল পরিষ্কার ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়তা দেবে। পরামর্শ ও সুপারিশ জানাবে। জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিদেশী দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষার পরই স্পষ্ট হবে ক্ষয়ক্ষতি এবং তা থেকে উদ্ধারের পথ বেরিয়ে আসবে। আর নানাজনের নানা মত ততদিনে শ্রবণ করে যাওয়া ছাড়া বোধ হয় আর কোন উপায় নেই।
×