ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী বিজয়ী জাতি

প্রকাশিত: ০২:৫৩, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

বাঙালী বিজয়ী জাতি

(২০ ডিসেম্বরের পর) এই কৌশলের অংশ হিসেবে জুলাই মাসে (৭১) হেনরি কিসিঞ্জার ভারত সফরে এসে সতর্ক করে দেন এবং পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ভারত ৯ আগস্ট (৭১) সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ভারতের কৌশল ছিল পাকিস্তানকে আক্রমণ না করা এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে প্রচার। কিন্তু পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে ৩ ডিসেম্বর’ ৭১ আর ভারত ছিল এই সুযোগের অপেক্ষায়। ভারত পশ্চিমে পাকিস্তানীদের প্রতিহত করার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণ করে সেই দিক থেকে এবং স্বীকৃতি প্রদান ৬ তারিখ অর্থাৎ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অংশ হানাদার মুক্ত করার পরে স্বীকৃতি। মাত্র ১৩ দিনে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শেষ হওয়া সম্ভব ছিল এজন্য যে, কতিপয় রাজাকার আলবদর ছাড়া গোটা জাতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। জনসমর্থন ছাড়া হানাদারবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের চাপে এমনিতে কাবু হয়ে যায়। কেবল পিছু হঠেছে ঢাকার দিকে, যৌথবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে বা আত্মসমর্থন করেছে পাকবাহিনী। পাকিস্তানের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর পরে চুপ করে থাকেনি। তারা গণচীনকে নিয়ে জোট বেঁধে একদিকে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বাঙালীর স্বাধীনতা নস্যাতের চেষ্টা চালিয়েছিল এবং অপরদিকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য ছাড়াও রণতরী সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সতর্ক সংকেতের জন্য শেষ পর্যন্ত আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া বাংলাভাষী নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করে সামরিক শাসনকে বেসামরিকীকরণের চেষ্টা চালিয়ে ভুট্টোকে জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর (৭১) জাতিসংঘের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ভুট্টো ছিঁড়ে ফেলেন এবং সদন্তে নিষ্ফল চিৎকার করেন এই বলে যে, “প্রয়োজনে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করব।” যুদ্ধ বিরতি হতে পারে এই আশঙ্কায় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলাদেশ ভূখ- পুরোপুরি মুক্ত করা সম্ভব হয়। যদি যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হতো তা হলে স্বাধীনতা দূরে থাক ফিলিস্তিনীদের মতো বাঙালীর অবস্থা হতো। সেদিন গোটা জাতির ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একমাত্র পরিচয় ছিল বাঙালী। কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। সেদিন আমাদের একটি মাত্র পরিচয় ছিল বাঙালী এবং মুখে ছিল জয় বাংলা। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে খুনীর অনুসারীরা তা উচ্চারণ করে না। এতে এখন হিন্দুয়ানার গন্ধ পাওয়া যায়। বলা হয় বাংলাদেশী। যেখানে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল সেই চিহ্ন মুছে ফেলতে নির্মিত হয়েছে শিশুপার্ক। এটি নাকি হিন্দুর কাছে মুসলমানের আত্মসমর্পণ। তাই কলঙ্ক মুছে ফেলার কাজটি করেছিলেন স্বাধীনতার কথিত ঘোষক দাবিদার জিয়া। আওয়ামী লীগ সরকার (৯৬-০১) স্মৃতিস্তম্ভ শুরু করেছিল কিন্তু শেষ করে যেতে পারেনি। পরবর্তী জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের চাইতে কথিত “৭ই নবেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস” বাংলাদেশীর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এর নগদ দাম ৩০ লাখ বঙ্গসন্তানের জীবন আর দুলাখ মা বোনের ইজ্জত। বাংলাদেশ কোন গোলটেবিলে জন্ম হয়নি। মানুষ দেশান্তরী হতে পারে, ভিনদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারে, ধর্মান্তরিত হতে পারে কিন্তু ত্যাগ করতে পারে না জাতীয়তা-বাঙালিত্ব। এটাই বাস্তবতা, আবেগের কথা নয়। সেদিন যারা পাক দোসর ছিল তাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন জিয়া-এরশাদ-খালেদা। বঙ্গবন্ধুর এক খলিফা শাজাহান সিরাজ নাকি শহীদ জিয়ার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং রাজাকারের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব ভোগী। যারা জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত হিন্দুর লেখা এই অজুহাতে জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে যারা চেয়েছে তারাও পুরস্কৃত হয়। কিন্তু মূলধারার সরকার ২০ বছর পর ক্ষমতায় এসে চেষ্টা চালাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠার। কিন্তু তা বিঘিœত হয়েছে ২০০১-০৬-এর জামায়াত-বিএনপি জোটের পাশ্চাতমুখিতা কিন্তু জনগণ পুনরায় মূলধারাকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ক্ষমতায় বসিয়েছে (২০০৯—-)। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে বেশ কয়েক জনের। ১ জনের কার্যকর হয়েছে। অন্যদের কার্যকরের অপেক্ষায়। ৭২-এর সংবিধান পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (২০১১)। প্রাণভরে উচ্চারিত হচ্ছে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পাকিস্তান ৭১-এর পরাজয় ভুলেনি। সেজন্য ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করিয়েছে এদেশীয় দোসর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে। জিয়া মারা গেলেও তার অনুসারী খুনীরা এখনও পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সচেষ্ট। ৭১ এর ঘাতকদের সঙ্গে নতুন করে যোগ দিয়েছে কাদের সিদ্দিকী। ড. কামাল হোসেন এখন আর তাঁর ৭২এর সংবিধান চান না। অর্থাৎ তিনি তাঁর আসল রূপ ধারণ করেছেন। ভুলেও উচ্চারণ করেন না জয়-বাংলা, বঙ্গবন্ধুর নাম। মনে রাখা প্রয়োজন, খুনীরা আত্মসমর্পণ করে না, করাতে হয়। সেই কঠিন কাজটি কিন্তু করছেন বাঙালীর শেষ ভরসা জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। এই সংগ্রামে বিজয় হতেই হবে। জাতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যারা মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক, জয় বাংলা স্বীকার করেন না তারা সাংবিধানিকভাবে এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন কিনা? জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। (সমাপ্ত)
×