ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গণভবনে ড্রোন হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনা হত্যার পরিকল্পনা ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

গণভবনে ড্রোন হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনা হত্যার পরিকল্পনা ছিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিস্ফোরক ভর্তি চালকবিহীন ড্রোন দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার মিশন বাস্তবায়নে মরিয়া জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা ও গণভবন। ড্রোন দিয়ে গণভবনে হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত আরও ৪ জনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে গোয়েন্দারা। গুপ্তহত্যার মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। ড্রোনের রেপ্লিকাসহ গ্রেফতারকৃত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদসহ বিভিন্ন সূত্রে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন শহীদ ফারুক হোসেন সড়ক এলাকা থেকে কোয়াড হেলিকপ্টার বা ড্রোনের কাঠের তৈরি একটি রেপ্লিকা, ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও উগ্রমতবাদ সংবলিত বইপত্রসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হয় মোঃ তানজিল হোসেন বাবু (২৬) ও মোঃ গোলাম মাওলা মোহন (২৫)। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য। সন্ত্রাস বিরোধী আইনে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়েরকৃত মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, শুধু জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জঙ্গী সংগঠনকেই স্বাধীনতা বিরোধীরা নানাভাবে সহায়তা করছে। তারা বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পক্ষে। এজন্য যেসব সংগঠন ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পক্ষে তাদের সহায়তা করে স্বাধীনতা বিরোধীরা। তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দেশে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। সূত্র বলছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে হিযবুত তাহরীরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে রীতিমত এক গোল টেবিল বৈঠক করে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটি বাংলাদেশে কার্যক্রম চালুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। জঙ্গী সংগঠনটি বাংলাদেশে আধুনিক জঙ্গীবাদের ধারা চালু করে। ধনাঢ্য ও রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের সংগঠনে টানা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের ছেলে রিসাদ কামাল খানকে হিযবুত তাহরীর তাদের দলে ভেড়ায়। পরবর্তীতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে হিযবুত তাহরীরের লিফলেট ও পোস্টারসহ রিসাদ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ২০০৯ সালে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই জঙ্গী সংগঠনটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে সংগঠিত হতে থাকে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত। সংগঠনের সদস্যরা ৪ থেকে ৫ জনের একেকটি দলে বিভক্ত হয়ে সিøপার সেল পদ্ধতিতে কার্যক্রম চালাতে থাকে। যাতে একটি দল ধরা পড়লেও আরেকটি দল সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না পায়। তারা ইসলামী শাসন কায়েমের পক্ষে। এমন আদর্শের কারণে স্বাধীনতা বিরোধীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হিযবুত তাহরীর ও হুজি জঙ্গীদের দিয়ে দেশে গুপ্তহত্যা চালিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের প্রতিবাদে রাজধানীর গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীর নিজ বাসার সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। গত বছরের ১ মার্চ রাজীব হত্যার দায়ে রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাইম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২) গ্রেফতার হয়ে রাজীব হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই তারা রাজীবকে হত্যা করেছে বলে জবানবন্দী দেন। গ্রেফতারকৃতরা হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য। সেই ধারাবাহিকতায়ই গত বছরের ৯ এপ্রিল বেলা সোয়া ১১টার দিকে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপকে নজরুল ইসলাম হল থেকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বুয়েট ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন (২৪)। পরে মেজবাহ আদালতে দ্বীপ হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই দ্বীপকে হত্যা করা হয়েছে বলে মেজবাহ জানান। সূত্রটি জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে নিষিদ্ধ করার বদলা নিতে চায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে থাকা হিযবুত তাহ্রীরের সদস্যরা। ক্ষমতায় থাকাকালে সেটি প্রায় অসম্ভব বিধায় তারা ড্রোন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। তাদের হামলার প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা ও গণভবন। তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের পর জঙ্গী সংগঠনগুলো অতিমাত্রায় বেপরোয়া হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ড্রোন দিয়ে ২৫ থেকে ৩০ তলা উঁচু ভবনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। তারা ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহনে সক্ষম একটি চালকবিহীন ড্রোন তৈরির দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল। বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোনে আকাশপথ দিয়ে দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র দ্বারা গণভবনে হামলা চালানোর পরিকল্পনাও ছিল তাদের। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ের সিংহভাগ আসার কথা ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছ থেকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, জঙ্গীদের প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই নানা মিশন নিয়ে নেমেছে জঙ্গীরা। তারই ধারাবাহিকতায় সব জঙ্গী সংগঠন একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের মধ্যে প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে উন্নতমানের মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। সেই সূত্র ধরেই চালকবিহীন আধুনিক ড্রোন আবিষ্কার করছিল তারা। ড্রোন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। তাদের টার্গেট শেখ হাসিনা। গণভবনে হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করা সহজ হবে, এমন ভাবনা থেকেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ড্রোন তৈরি করছিল। বিস্ফোরক ভর্তি করে ড্রোনটি দিয়ে গণভবনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্য রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক সংগঠনটির আরও ৪ সদস্যকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তাদের টার্গেট দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও হামলার টার্গেটে থাকা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
×