ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাফের ঘটনায় বদলে যাওয়া সিডনি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

ক্যাফের ঘটনায় বদলে যাওয়া সিডনি

একটি ছোট চকলেট ক্যাপে সিডনিকে বদলে দিয়ে গেছে, হয়ত চিরকালের জন্য পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এমন টান টান উত্তেজনা, আতঙ্ক আর দুর্ভাবনা কোন দিন দেখিনি। ঘটনার বিশালতা কিংবা আকারের চেয়েও বড় কথা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এ জাতীয় সন্ত্রাসী হামলা আগে কখনও ঘটেনি। আমরা ঝড় জল বন্যা খরায় মানুষের মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত। বেশ কিছু দিন থেকে নানামুখী হুংকার ও ঘোষণার পর সোমবার সকালে সত্যি সিত্য বিপদের মুখে পড়ল অনুপম নগরী সিডনি। সকালে ঘুম থেকে জেগে টিভি দেখা, রেডিও শোনার ফাঁকে কখন যে এমন একটি বিপদ ওঁৎ পেতে ছিল কেউ টের পায়নি। সিডনি বিশাল এক শহর যেটাকে সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বলছি সেটিও আয়তনে কম কিছু না। মার্টিন প্লেস এর হৃৎপিণ্ড। ঠিক যে জায়গায় এই চকলেট ক্যাফে তার উল্টো দিকে ছিল আমাদের অফিস। ঐ জায়গাটি নানা কারণে জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাফের আরেক দিকে আকাশচুম্বী দালানটির দিকে তাকলেই বুঝবেন এর গূঢ় বা অন্তর্নিহিত গুরুত্বের কারণ। অকাশছোঁয়া উচ্চতার একটি ভবনে হাওয়ারও নাগালের বাইরে যে স্তর তার চারপাশে নাগিনীর মতো ঘিরে আছে আধুনিক যত যন্ত্রপাতি। এটি আমেরিকান দূতাবাস। ঐ ক্যাফেটির আরেক দিকে রিজার্ভ ব্যাংকের বিশাল দফতর। অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় চ্যানেল, চ্যানেল সেভেনের দফতরও লাগোয়া। কিছুদিন পূর্বে জঙ্গীরা সকাল বেলার জনপ্রিয় শো চলাকালে সেখানে অনর্থ ঘটানোর হুমকি দিয়ে দিয়েছিল। তৎপর পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ তা বানচাল করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর বলে হয়ত সে কারণেই ক্যাফেটি বেছে নেয় এই দুর্বৃত্ত। যে কারণে বা যেভাবেই হোক এই ঘটনা এখানকার জীবনকে নতুন বাস্তবতার সন্ধান দিয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত দুপুর অব্দি টানা উত্তেজনা আর নির্ঘুম অস্ট্রেলিয়ায় এমন ঐক্য ও সম্প্রীতি আগে দেখিনি। সব সময় মনে হতো কেমন যেন বিচ্ছিন্ন ও ছাড়া ছাড়া ভাব। কেউ এশিয়ান, কেউ আফ্রিকান, কেউ ইউরোপিয়ান, কেউ বা আদিবাসী। দাফতরিক কথ্য ও লেখ্য ভাষা ছাড়া বাড়িতে সবাই যার যার দেশের ভাষায় কথা বলে, কেউ কারও ভাষা বোঝে না। খাবার চেনে না, পোশাক বা আচরণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সে দেশে কি বিপুল ও গভীর ঐক্য সম্ভব? বিপদে পড়লে যে তা সম্ভব এবং সে ঐক্য বজ্র আঁটুিন হয়ে সমাজকে ধরে রাখতে পারে এই ঘটনা সে দিকটা দেখিয়ে দিয়ে গেল। রাতভর এ্যাকশন পাল্টা এ্যাকশন দেখে ক্লান্ত মানুষ ঘুমহীন বা আধো জাগা থেকে ছুটে গিয়েছে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে। মার্টিন প্লেস ও আশপাশের ফুলের দোকানগুলো ফুলের যোগান দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। ফুলের মনুমন্টে হয়ে যাওয়া জায়গাটি মানুষের কান্না, ক্রোধ, অব্যক্ত বেদনায় গড়ে দিয়েছে নতুন অস্ট্রেলিয়ান ঐক্য। খ্রিস্টমাস বা বড়দিনের উৎসব এখানে আমাদের ঈদ, পূজার মতো, শপিংমলগুলো ভিড় আর ক্রেতার পদভারে পরিপূর্ণ, চারদিক সাজ সাজ আর উৎসবের আবহাওয়া, যে জোয়ারে ছেদ পড়েছিল, ভাটা পড়েছিল সে দিন। প্রধানমন্ত্রী থেকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশের কর্তা- সবাই অনুরোধ জানিয়েছিলেন, জীবন যেন চলমান থাকে। বিজয়ের মাসে লক্ষ্য করলাম, তাই হয়েছে। আবেগ ও শোকের মাতম থামিয়ে যথাযোগ্য শ্রদ্ধা আর ভালবাসাকে এরা ছুটির দিনে পরিণত করে না। আশ্চর্যের ব্যাপার নিহতদের পরিবারেও দেখলাম শান্ত অবিচল ও ভালবাসা মিশ্রিত শোকের আবহ, তাঁরা স্বজন হারানোর পরও কর্তৃপক্ষের প্রশংসা ও নিবেদিত শ্রমের প্রশংসা করতে ভোলেননি। রাষ্ট্রযন্ত্র, নিরাপত্তাকর্মী সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার প্রতি এমন অনুরাগ ও নিষ্ঠা আস্থার প্রতীক। এতেই তো সমাজে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়। মিডিয়াকে দেখলাম, দেখে শিখলাম, তাঁরা যাই প্রচার করেছে তার ভেতর অতিরঞ্জন বা অতি আবেগ ছিল না। তবে এটা ঠিক ধর্মের নামে জঙ্গীপনা, উন্মাদনা মানুষকে জিম্মি রেখে উন্মাদের মতো নিজের কথিত চাহিদা আদায়ের নামে আজ সন্ত্রাস বিশ্বকে নুতনভাবে জাগতে ও ভাবতে বাধ্য করেছে। ছোট চকলেট ক্যাফের বড় ঘটনাটি এই দেশে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে। জীবনে চিন্তায় আচরণে আসবে নতুন পরিবর্তন। আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় বঙ্গীবাদের জায়গা নেই। সেটাই এখন বুঝে গেছে সিডনি। সামনের দিনগুলোতে যারা তা মানবেন না তাদের জায়গা হবে না সমাজ। আমাদেরও সাবধানতার কোন বিকল্প নেই। সিডনি, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪
×