ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী বিজয়ী জাতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

বাঙালী বিজয়ী জাতি

(১৮ ডিসেম্বরের পর) ক্যাপটেন রফিক রাত পৌনে ন’টায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা ডা. জাফরকে জানিয়ে বলেন, অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিস ছিল ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ষোলশহরে ২নং রেলগেটের কাছে। ক্যাপ্টেন রফিক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন এই খবর ইবিআরসির দফতরে পৌঁছে রাত ১১টার দিকে। এর অনেক আগেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনী বাঙালী সৈনিকদের হত্যা করতে শুরু করেছে এবং গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল ইবিআরসি অফিস থেকে। বাঙালী সৈনিকরা অনেকে পাহাড়ী এলাকা দিয়ে বেরিয়ে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইয়া গুলির আওয়াজ ক্যান্টনমেন্টের বাইরের বাসায় বসে শুনতে পান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য শহর এলাকায় চলে আসেন। রাত ১১টায় যখন ইবিআরসি দফতরে ক্যাপ্টেন রফিকের বার্তা পৌঁছে তখন ডিউটি অফিসার ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান জানান, ইউনিট প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান ‘সোয়াত’ জাহাজে আনীত পাকবাহিনীর অস্ত্র খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রওনা হয়ে গেছেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তখন মোটরসাইকেল নিয়ে মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনতে যান এবং আগ্রাবাদ (পাঠানটুলী) এলাকায় দেখতে পান যে জিয়া রাস্তায় বাঙালীর দেয়া রেবিকেড পরিষ্কার করছেন বন্দরে যাওয়ার জন্য। ঘটনার বিবরণ দিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান জিয়াকে ব্যারাকে নিয়ে আসেন। রাত দু’টায় ব্যারাকে ফিরে এসে মেজর জিয়া তার বাঙালী সৈনিকদের কাছে বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করে ‘স্থানটি নিরাপদ নয়’ এই অজুহাতে শেষ রাতের দিকে ষোলশহর রেল লাইন দিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ পার হয়ে বোয়ালখালী থানার করইল ডাঙা গ্রামে পাহাড়ের কাছে অবস্থান নেন ২৬ মার্চ সকাল ১০টায়। ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হন যে হয় তাঁকে বন্দী অথবা হত্যা করা হবে। কিন্তু তার পূর্বে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রস্তুত করে ফেলেন এবং রাত বারোটা নাগাদ বন্দী হওয়ার পূর্বেই টিএন্ডটি/ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারের ব্যবস্থা নেন। রাত ১০টার মধ্য বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ, যুবনেতা শেখ মনি, তোফায়েল আহম্মেদ, নুরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ বিশ্বস্তদের নিরাপদে চলে গিয়ে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন তা বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে দ্রুত বিদায় করে দেন। স্বাধীনতার মূল ঘোষণাটি ছিল ইংরেজীতে যা নিম্নরূপ : This may be may last message. From today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh Wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan Army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. JOY BANGLA. (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র ৩য় খন্ড পৃ. ১) রাত বারোটা নাগাদ একদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকবাহিনী বন্দী করে অপরদিকে (২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রেকর্ডকৃত স্বাধীনতা ঘোষণা বাণী টিএন্ডটি/ইপিআর ওয়্যারলেস নেট ওয়ার্কে দেশব্যাপী প্রচার হতে থাকে। চট্টগ্রামে ওয়্যারলেস বিভাগের মাধ্যমে রাত একটা নাগাদ জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাটি পান এবং তা এম এ হান্নান এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বঙ্গানুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল করে শহরে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া সে রাতেই মাইকযোগে প্রচার করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সমগ্র বাংলাদেশের জেলা/ মহকুমা শহরে সে রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে প্রচারিত হয়। ২৬মার্চ সকাল নাগাদ গ্রামাঞ্চলেও টিএন্ডটির মাধ্যমে টেলিগ্রাম আকারে এই খবর ছড়িয়ে পরে। হানাদার বাহিনীর জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক “উইটনেস টু সারেন্ডার” নামক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সম্মিলিত যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাতে (পৃ. ৫) উল্লেখ রয়েছে যে, “যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মনে হলো পূর্ব রেকর্ডকৃত। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করলেন।” তৎকালীন ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রভাবশালী ছাত্রনেতা কাজী আরেফ আহমেদ (পরবর্তীতে জাসদ সংগঠক-প্রয়াত) সাপ্তাহিক বিচিত্রা স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা/৯০ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, “রাত ১০টার কিছু পর সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ইকবাল হলে এসে তাদের জানালেন, কিছু সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা ইপিআর-এর পিলখানাস্থ ওয়্যারলেস সেট থেকে প্রচার করা হবে। “কাজী আরেফ ও মেজর সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য থেকে ইহাই স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি টেপে ধারণ হয় ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের সন্ধ্যা এবং রাত ১০টার মধ্যে কোন এক সময় যা ইপিআর ও টিএন্ডটি বিভাগের মাধ্যমে রাত ১২টার পর প্রচার করার নির্দেশ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কালুরঘাটস্থ ট্রান্সমিটিং সেন্টার চালু করে স্বকণ্ঠে প্রচার করেন দুপুর দুটো নাগাদ। একই দিন রাতে বিবিসির সান্ধ্যকালীন অধিবেশনে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন, যা গোপন বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছে। অপর দিকে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, পূর্ব পাকিস্তানে তার সরকারের কর্তৃত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের উপর যুদ্ধ শুরু করেছেন। “এম এ হান্নানের কণ্ঠেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল বলে তৎকালীন ঘটনার প্রত্যক্ষকারী মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূইয়া প্রমুখ তাঁদের গ্রন্থে/ রচনায় উল্লেখ করেছেন। মেজর মীর শওকত আলীর (পরে লে. জে. এবং বিএনপি নেতা-মন্ত্রী) ভাষায়, যদি বলা হয় প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল তা হলে আমি বলব, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর।” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র- নবম খণ্ড দ্রষ্টব্য)। মেজর জিয়াউর রহমান বেতার ভাষণ দেন ২৭ মার্চ। তিনি ২৬ মার্চ করইলডাঙ্গা গ্রামে ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ তাঁর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গ্রন্থে (পৃ. ৫২) লিখেছেন, বেতার কেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য মেজর জিয়াকে করইলডাঙ্গা গ্রাম থেকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় এবং বেতার ভাষণ দেন। (চলবে)
×