ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুড়ঙ্গ কেটে ভল্ট ভেঙ্গে ব্যাংকের টাকা লুট

নিরাপত্তা তদারকিতে এবার মাঠে নামছে বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

নিরাপত্তা তদারকিতে এবার মাঠে নামছে বাংলাদেশ ব্যাংক

রহিম শেখ ॥ নির্দেশনা সত্ত্বেও ব্যাংকের শাখায় কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সরকারী-বেসরকারী কিছু ব্যাংক। ফলে সুড়ঙ্গ কেটে ভল্ট ভেঙ্গে ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। বেসরকারী ব্যাংকের কিছু শাখাও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় এবার নির্দেশনা নয়, ব্যাংকগুলো শাখায় ভল্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে মাঠে নামছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকের আমানত সুরক্ষিত রাখতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে হার্ডলাইনে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ভল্টের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য ব্যাংকের শাখাগুলো শক্ত ভবনে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাংকের ভল্টে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত টাকা না রাখারও পরামর্শ দিলেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জানা গেছে, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখায় সুড়ঙ্গ কেটে ভল্ট থেকে ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা ডাকাতি করে দুষ্কৃতকারীরা। এরপর ৯ মার্চ একই ব্যাংকের বগুড়ার আদমদীঘি শাখায় একই কায়দায় ৩২ লাখ টাকা লুট হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের ব্র্যাক ব্যাংক থেকে দেয়াল কেটে ভল্ট থেকে ২ কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। এর আগেও ব্র্যাক ব্যাংকের রাজধানীর ধানম-ি শাখা থেকে লকার ভেঙ্গে কয়েক হাজার ভরি সোনা লুট হয়। গত ৪ ডিসেম্বর রাজশাহী নগরীতে সোনালী ব্যাংকের কোর্ট বাজার শাখায় সুড়ঙ্গ কেটে ডাকাতির চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ রবিবার গাজীপুরের জয়দেবপুরে জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা থেকে ৬০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। একই দিন জনতা ব্যাংকের শ্যামপুর শাখার সিঁড়িতে এক ব্যবসায়ীর ব্যাগভর্তি ১৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এর আগে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে কমপক্ষে ১৪ ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের চেক, ডিডি, এফডিআর ডকুমেন্ট, এসডিআর, এমটিডিআর, পে-অর্ডার, আমদানি-রফতানির এলসি ডকুমেন্টের মতো গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকশ’ নথি চুরি হয়ে যায়। ভল্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি একটি নির্দেশনা জারি করে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত অর্থের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো সেসব যথাযথভাবে পালন করছে না। সে কারণেই সম্প্রতি ভল্টের নিরাপত্তাবেষ্টনী ধ্বংস করে ভল্টে রক্ষিত অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ব্যাংককে তিন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমত, ব্যাংকের ভল্টকে বিশেষভাবে সুরক্ষিত করার জন্য ইস্পাতবেষ্টনী নির্মাণসহ ভল্টে সিকিউরিটি টেস্টেড দরজা স্থাপন করতে হবে। মেঝে ও ছাদসহ ভল্টের চারপাশের নির্মিত দেয়ালের নিরাপত্তার বিষয়টি পুরপ্রকৌশলীর কাছ থেকে প্রত্যায়িত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভল্টের অভ্যন্তরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ ভল্টে সিকিউরিটি অ্যালার্মের সর্বক্ষণিক ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় তথ্য ব্যবস্থার (সেন্ট্রাল ইনফরমেশন সিস্টেম) নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ ব্যবস্থা রাখতে হবে। সব ভল্টের ভেতর স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (অটোমেটেড ফায়ার এক্সটিংগুইশার) স্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ভল্টে রক্ষিত সব অর্থের সম্পূর্ণ বীমা করে রাখতে হবে। সর্বশেষ ১৭ নবেম্বর ব্যাংকের সব শাখা ঘিরে ক্যামেরা বসানোর নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক স্থাপনার অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নিমিত্তে ব্যাংক শাখার প্রবেশ পথে, শাখার অভ্যন্তরে এবং শাখার বাইরের চতুর্দিকে ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডারসহ ন্যূনতম প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিসিটিভি/আইপি ক্যামেরা/স্পাই ক্যামেরা স্থাপন করার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা মানেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, রাজধানী ও বড় বড় শহরের শাখাগুলোয় নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও পুরোপুরি নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। এ ছাড়া মফস্বলের শাখাগুলোর নিরাপত্তা আগের মতোই আছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সারাদেশেই দুর্বল। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে আমরা একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো শাখায় ভল্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে কিনা তা তদারকি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে কোন ছাড় দেয়া হবে না বলেও তিনি জানান। মাহফুজুর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জামালপুর জেলার সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা পাইলট প্রকল্প হিসেবে নিয়েছি। ধাপে ধাপে সব জেলার ব্যাংক শাখার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হবে। ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার জনকণ্ঠকে বলেন, সব ব্যাংকের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা তো রয়েছে। আমরা এবিবির পক্ষ থেকে একাধিকবার ব্যাংকগুলোকে ই- মেইলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আরও জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু তারপরও সরকারী ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারী ব্যাংকে দুর্ঘটনা ঘটছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের সব শাখায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সময়ের ব্যাপার। তিনি বলেন, যে ব্যাংকের শাখা বেশি, সে ব্যাংকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সময় লাগছে। তিনি আরও বলেন, তবে সরকারী ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে এখনও পুরনো পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এতে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
×