ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

এভাবেই সামনে যেতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

এভাবেই সামনে যেতে হবে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ক্ষুদ্র একজন ডাক্তার হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৯, তেত্রিশ বছরে আমার যা অর্জন হয়েছে, ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র স্বার্থে তা বিসর্জন দিতে চাই না। সেদিক বেশি কথা বলিনি। কেননা ছোট বেলা থেকে পারিবারিক শিক্ষার একটি অংশ ছিল ‘গুলি আর বুলি একবার বেরিয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না।’ এর আগে ২০০১ সালে ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এ্যাকাউন্টে কয়েক কোটি টাকা রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নেই কোষাগার প্রায় শূন্য ছিল। কিন্তু দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়নি, না স্থাপনায়, না শিক্ষায়, না গবেষণায়, না চিকিৎসায়। অধ্যাপক কাদেরী স্যারের নেতৃত্বে যে জবংবধৎপয ঢ়ৎড়মৎধস চালু হয়েছিল তা জোট সরকারের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। রেসিডেন্সি একমাত্র প্রশিক্ষণ পদ্ধতি যা পুরো বিশ্বে স্বীকৃত। বর্তমানে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চালু হওয়ার পরে মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৪০০টি গবেষণা কাজ হচ্ছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পরেই ডিপিপি তৈরির কাজে হাতে দেই যা ঈবহঃৎব ড়ভ ঊীপবষষবহপব চযধংব ওও ইঝগগট হিসেবে আখ্যায়িত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এবং পরিকল্পনা কমিশনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের সহায়তায় আমরা ১০ জানুয়ারি ২০১০ আপনার সরাসরি দিকনির্দেশনায় একনেক-এর সভায় ডিপিপি পাস করাতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ডিপিপি উপস্থাপনার পরপরই কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত, আপনি সভাপতির আসনে বসে দেবদূতের মতো বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভিসিকে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হউক।’ আমি ৪/৫টি বাক্য বলার পরেই, আপনি স্বগর্বে পাস পাস পাস বলে আমাদের ডিপিপিটি পাস করিয়ে দেন। ১০ জানুয়ারি যেমন এ জাতির জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি ঐতিহাসিক দিন অর্থাৎ ‘বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ দিবস।’ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম সংসদ নির্বাচন হয়। ৯ মার্চ সদ্য নির্বাচিত একজন এমপি সাহেবের সঙ্গে ৩২নং-এ ঐতিহাসিক বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক মরহুম নূরুল ইসলাম স্যার উপস্থিত হন। চিকিৎসক কিছু বলার আগে দূরদর্শী রাজনীতির দার্শনিক জাতির পিতা বললেন, ‘প্রফেসর সাহেব, আপনি শাহবাগ হোটেল থেকে পিজিটাকে মহাখালী, সোহ্রাওয়ার্দী কমপ্লেক্স অথবা সাভারের কাছে কয়েক শ’ বিঘা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলেন। আপনি জিন্নাহ পোস্টগ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট দেখেননি, আমাকে তো জেল থেকে ঐখানে নিয়ে যাওয়া হতো চিকিৎসার জন্য।’ আজকে সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করলেই, কোন জায়গা নেই। তারপরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০০ সালে আপনি যখন ক্ষমতায় তখন শেরাটনের উল্টোদিকের আড়াই বিঘা জায়গাটি ১০০১ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছিলেন, আমি তখন ট্রেজারার হিসেবে এই জায়গা বুঝে নেই। এবার কেবিন ব্লকের উত্তর দিকের ১২ বিঘা জায়গা আপনার নির্দেশনায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমরা প্রায় ১৮ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেই। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ বেতার ভবনটি এখনও বুঝে পাই নাই। কেবিন ব্লকের উত্তর দিকের এই জায়গায় কোরিয়ার ঊউঈঋ-এর সহযোগিতায় ৭০০ শয্যার একটি সুপার স্পেশিয়ালাইজড হাসপাতাল হচ্ছে কোরিয়ান ঊঢওগ ইধহশ’র ১০০০ কোটি টাকার সহজ শর্তের ঋণে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময় জীবনের প্রণিধানযোগ্য উক্তি, হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মহান উক্তি ‘মহৎ কিছু অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন’কে মেনে চলেছি এই ব্রত হৃদয়ে ধারণ করে আমরা চলেছি। জীবনের বাকি দিনগুলোও এভাবে চালিয়ে যেতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার পারিবারিক শিক্ষা “ঘড়ঃযরহম রং ংবপৎবঃ, ঘড়ঃযরহম রং রসঢ়ড়ংংরনষব, হড় নড়ফু রং রহ ফরংঢ়বহংধনষব” আমাকে সবসময়ই সাহস যোগায়। বঙ্গবন্ধুর উক্তি ও আদর্শ, আমার পারিবারিক শিক্ষা, সর্বোপরি আপনার স্নেহ নিয়ে এগিয়ে গেলে থেমে থাকতে হবে না। ২০০১ হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এত দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতা, চিকিৎসা শিক্ষা বিপর্যস্তকরণ, বদলি, পদোন্নতিতে শৃঙ্খলাভঙ্গের পরেও আমরা দায়িত্ব নেয়ার পরে প্রথম ডিন নির্বাচনে সুযোগ্য প্রার্থীর কারণেই আমরা বিজয়ী হই। অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া, অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান, অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ এবং অধ্যাপক শামসুল আলম সবাই বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। নূতন নূতন বিভাগ, উইং খোলা হয়েছে, যার অন্যতম হলো Centre for Neurodevelopment and Autism in Children, Rheumatology department, Endocrinology department, Public Health and Informatics, Palliative Care wing, Respiratory Medicine wing| CNAC নূতনভাবে খোলা হয়েছে এবং যা সৃষ্টিতে আপনার সহযোগিতা, পরামর্শ, উপদেশ এবং আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের ভূমিকাই ছিল একমাত্র ভরসা এবং উপাদান। বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে অঁঃরংস এবং ঘউউ-তে বিশ্বের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। যার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিও লাভ করেছেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। এ গৌরব এবং অর্জন বাংলাদেশের অটিজম ঘউউ ঈযরষফৎবহ-দের। সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের। তাছাড়াও আপনার পরামর্শেই ই.ঝপ. ঘঁৎংরহম খোলা হয়েছে এবং আমাদের নার্সদের ঝড়পরড়ষড়মু, চযুপযড়ষড়মু, ওঞ ঃৎধরহরহম, ঊহমষরংয-সহ আনুষঙ্গিক সব দিকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এরা এখন রফতানিযোগ্য জনশক্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে আপনি হত-দরিদ্রের জন্য ৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত এ তহবিলের যথেষ্ট অপচয় হয়েছিল। এবার আপনি আরও ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন যা দু’ভাবে হত-দরিদ্রের জন্য ৫ কোটি এবং পঙ্গু ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫ কোটি টাকা স্থির জমা রেখে, তার লভ্যাংশ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা হচ্ছে। শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং মাতৃস্বাস্থ্যের পরিচর্যায়, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গউএ অর্জনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। স্নাতকোত্তর বাছাই পরীক্ষা বা ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রত্যেকটি পরীক্ষা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েও ভর্তি হয়েছেন। আমাদের সময়ে ভর্তি পরীক্ষা কমিটিতে সব মতাদর্শের চিকিৎসকদের নিয়ে কমিটি করে এমনভাবেই পরীক্ষা নেয়া হয়েছে যে এপর্যন্ত কোন দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠেনি। কোন সাংবাদিক বন্ধু এ নিয়ে কোন প্রশ্ন যেমন তুলতে পারেননি, তেমনি ভিন্ন মতাদর্শের কোন সহকর্মীও সমালোচনা করতে পারেননি। উচচ-তে বহিঃবিভাগ ঙচউ-১ ছিল যা আজিজ সুপার মার্কেটসংলগ্ন খালি জায়গায়। বহিঃবিভাগ-২ একই সঙ্গে তৈরি করার নিমিত্তে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করি। যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্জন। শুধু অপচয়রোধ করলে তা সম্ভব। কেবিন ব্লকের পাশেই জমি ক্রয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা, গজও, ঈঞ ঝপধহ ক্রয় ১৮ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা নিজস্ব আয় থেকে ব্যয় করি। যদিও আমাদের সব পরীক্ষার খরচ আশপাশের যে কোন হাসপাতালের চেয়ে অর্ধেক। যেখানে ৫০% শয্যা বিনা ভাড়ায়। কেবিন ভাড়া যে কোন হাসপাতালের এক-তৃতীয়াংশ। বৈকালিক বিশেষজ্ঞ বহিঃবিভাগ এদেশে পাবলিক প্রতিষ্ঠানে প্রথম চালু হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাই আমরা এখন প্রাতিষ্ঠানিক Practice ev Institutional practice-এর কথা চিন্তা করছি। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি ঘড়হ-ঢ়ৎধপঃরপরহম-এর দিকে চলে আসেন তাহলে AIIMS, PGI Chandigar and NUH-এর মতো আমরা সুনাম অর্জন করব। ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে কক্ষচ্যুত হয়েছিল। আমাদের দায়িত্ব লাভের পর আমরা স্বচ্ছতার ও দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থা থেকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসি। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশৃঙ্খল বিধিমালার মাধ্যমে সুন্দর গতিতে এগিয়ে চলছে। এ জন্য শিক্ষক, চিকিৎসক, গবেষকসহ সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সেবিকাদের আমি সব কৃতিত্ব দিতে চাই। তবে এ কথা সত্য, অনেক সময় আমরা চিকিৎসকরা হয়ত রোগীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারি না- যা অনাকাক্সিক্ষত। চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত সহকর্মীদের কাছে, রোগী হলো দেবতা এবং হাসপাতাল হলো মন্দির। অর্থাৎ ডাক্তার রোগী ও হাসপাতালের সম্পর্ক হলো পূজারী-দেবতা এবং মন্দিরের। গত ৬ বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল এক ঘণ্টার জন্য কর্মচারী, চিকিৎসক বা নার্স অসন্তোষ হয়নি বিধায় এক দিনের জন্যও হাসপাতালের স্বাভাবিক কর্মকা- বিঘিœত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য নীতিতে বর্তমান সরকারের গৃহীত কার্যকর ও গঠনমূলক পদক্ষেপ স্বাস্থ্যনীতিকে এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সমপর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এ কৃতিত্বের ভাগীদার সরকারের পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজেরও। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×