ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৭৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলে জিএফআইর রিপোর্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তার মন্তব্য

ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার অসম্ভব, হয়ে থাকলে উদ্ধার করা হবে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার অসম্ভব, হয়ে থাকলে উদ্ধার করা হবে

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। অর্থনীতির উন্নয়ন শুধু টাকায় নয়, প্রযুক্তিতেও এসেছে। প্রযুক্তির বদৌলতে ব্যাংকিং খাতের সবকিছুই এখন অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। তাই বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাচার সম্ভব নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ফলে গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাঁচ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় বাড়ছে আমদানি। তারপরও বাংলাদেশ থেকে যদি টাকা পাচার হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার আদৌ হয়েছে কিনা, তা সরকারকে অনুসন্ধান করতে হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য সঠিক কিনা, তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। মঙ্গলবার প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) দেয়া তথ্য মতে, ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৭৮ কোটি ডলার অবৈধ পথে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। এতে বিশ্বের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে গত এক দশকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে, তার প্রাক্কলন করা হয়েছে। জিএফআই ১৫১টি দেশের অর্থ পাচারের হিসাব প্রাক্কলন করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫১তম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের উপপ্রধান ও নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্য কোন মাধ্যমে অর্থ পাচার ঘটলেও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাচার সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ফলে গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাঁচ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়ায় আমদানিও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা রিপোর্টে ২০১২ সালের অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। আর তা প্রকাশ করা হয়েছে দুই বছর পর। বর্তমান সময়ের সঙ্গে ওই রিপোর্টের তুলনা করা ঠিক হবে না। তারপরও বাংলাদেশ থেকে যদি টাকা পাচার হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে ২০০৩-২০১২ সময়কালে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে চীন থেকে, যার পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে আছে রাশিয়া, ৯৭ হাজার ৩৮৬ কোটি ডলার। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে নাম রয়েছে যথাক্রমে মেক্সিকো (৫১ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার) ও ভারত (৪৩ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলার)। পঞ্চম স্থানে আছে মালয়েশিয়া (৩৯ হাজার ৪৮৭ কোটি ডলার)। আর ভারত থেকে ২০১২ সালে নয় হাজার ৪৭৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাইরে চলে গেছে। পাচারের তালিকায় ভারত ৪ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশ। জিএফআই বলছে, ২০০৩-২০১২ সময়কালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অন্তত ছয় লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার অবৈধ পথে বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালেই বেরিয়ে গেছে ৯৯ হাজার ১২০ কোটি ডলার, যা কিনা আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। জিএফআই বলছে, ট্রেড মিস ইনভেয়েসিং বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চালানের গরমিলের মাধ্যমেই বেশি পরিমাণ অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানি-রফতানির চালানে প্রকৃত মূল্য আড়াল করে কমবেশি দেখিয়ে একদিকে কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মোটা অঙ্কের অর্থ দেশে না এনে বাইরেই রেখে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও খাদ্যপণ্য আমদানিতে কোন শুল্ক নেই। কাজেই এ সব পণ্য আমদানিতে বাড়তি মূল্য দেখিয়ে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার রফতানির অর্থ পুরোটা সঠিকভাবে দেশে না এনে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার সুযোগ আছে। এটাও টাকা পাচার। জিএফআই যে ট্রেড মিস ইনভয়েসিংয়ের কথা বলেছে, তা অনেকটা যৌক্তিক বলা যায়। তবে টাকা পাচারের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে তিনি মনে করেন। জিএফআইর তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মাহফুজুর রহমান বলেন, অর্থ পাচার রোধে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বেড়েছে। এছাড়া কাস্টমসের কার্যক্রম অটোমেশন করা হয়েছে। তাই মিস ইনভয়েসিং করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিদেশে অর্থ পাচার আগের চেয়ে কমেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার আদৌ হয়েছে কিনা, তা সরকারকে অনুসন্ধান করতে হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য সঠিক কিনা, তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের খবর শোনা যাচ্ছে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় অনেকেই দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছেন। আবার কর ফাঁকি দিতেও বিদেশের ব্যাংকে গোপনে টাকা রেখেছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেশ বাড়ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতিতে আন্ডার ইন ভয়েসিং হচ্ছে কিনা, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মনে করেন। প্রসঙ্গত, গত জুনে ইউএনডিপি প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। সে হিসাবে গত চার দশকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এ অর্থ পাচারের মূল পন্থা আমদানি-রফতানিতে পণ্যের মূল্য কমবেশি দেখানো (মিস ইনভয়েসিং)। আমদানি-রফতানিতে পণ্যের মূল্য বেশি ও কম দেখানোর মাধ্যমে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাকিটা বিভিন্ন দেশের এজেন্টের মাধ্যমে হুন্ডি করে পাচার হয়। জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০১৩ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের গচ্ছিত রয়েছে প্রায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগে ২০১২ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের প্রায় ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার সমান জমা রয়েছে।
×