ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্যালা নদীতে আর তেমন তেল নেই

বন্যপ্রাণীর দেখা মিলছে না, চলে গেছে বনের গহীনে

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

বন্যপ্রাণীর দেখা মিলছে না, চলে গেছে বনের গহীনে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগমারীতে দুর্ঘটনায় সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি ফার্নেস অয়েল ভর্তি কার্গো জাহাজ ডুবির দু’দিনের মধ্যেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। ছড়িয়ে পড়া তেলের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় খাল-নদী তীরের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল মরতে শুরু করেছে। শ্যালা নদীর আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা মিলছে না রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর। তবে ডলফিনের দেখা মিললেও অন্য জলজ প্রাণী ও জীবজন্তুর দেখা না মেলায় হতাশায় জেলে-বনজীবীরা। তাঁদের ধারণা, ফার্নেস অয়েলের প্রভাবে আশপাশের বন্যপ্রাণী অন্যত্র চলে গেছে। তবে বন বিভাগ বলছে, ফার্নেস অয়েল অপসারণে অনেক লোকের আনাগোনা ও সুপেয় পানির অভাবে বন্যপ্রাণী বনের গহীনে চলে যেতে পারে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নদীপথে ৫০ কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়েছে। এ তেল অপসারণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রশাসন ও বন বিভাগ দাবি করছে। এখন আর তেল তেমন নেই ॥ শ্যালা নদীসহ ১৮টি খালে তেল অপসারণে নতুন পদ্ধতি হিসেবে কচুরিপানা ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক লোক সুন্দরবনের নদী-খালের তেল সংগ্রহের কাজ করছে। বন বিভাগ, মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কচুরিপানা ছড়িয়ে ও পাম্প মেশিন দিয়ে পানি স্প্রে করে তেল অপসারণ এবং সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রয়েছে। মৃগমারী এলাকায় তেল অপসারণের যুক্ত জয়মনি ঘোলের সালেহা বেগম, গফফার, আল-আমিন জানান, আগের মতো তারা তেল পাচ্ছেন না, নদীর পানিতে এখন আর তেল তেমন নেই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে এখন তাঁরা তেল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। বিশেষজ্ঞদের মত ॥ এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর তৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ওই সময় ভরা জোয়ার থাকায় নদীসহ ছোট-বড় খাল ও বনের মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিপর্যয়ের মাত্র অনেকগুণ বেড়ে যায়। অথচ সুন্দরবনে তেল দূষণের ওপর ২০০২ সালে গবেষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে জাপান অয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, ফুয়ো ওশ্যান ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের কনসোলিডেটেড সার্ভিস লিমিটেড যৌথভাবে ম্যানগ্রোভ বনে তেল দূষণের প্রভাব এবং করণীয় বিষয়ে এ গবেষণা চালানো হয়। এ বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী জানতেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এমন একটি গবেষণা হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না। আমাদের মধ্যে তা প্রচার করা উচিত ছিল, জানা থাকলে অবশ্যই তৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতাম।’ এ সমীক্ষায় বলা হয়, তেল দূষণের প্রতিক্রিয়ায় প্রথম ১৫ দিনের মধ্যে পাখি, কচ্ছপ, ছোট মাছ ও অমেরুদ-ী প্রাণী মারা যাবে। ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ছোট ছোট বাদাগাছ মারা যাবে, বড় বাদাগাছের পাতা ঝরে পড়বে। এক বছরের মধ্যে মাঝারি আকারের গাছপালা মরে যাবে এবং কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে এক বছরের পর থেকে বড় গাছপালাও মরতে শুরু করবে। এ গবেষণায় তেল দূষণ মোকাবেলায় উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে ১২ বছর পার হলেও সেই অবকাঠামো ব্যবস্থা জোরদার করা যায়নি। এ ব্যাপারে পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীববৈচিত্র্যে সুন্দরবন একটি স্বতন্ত্র ইকো সিস্টেম। একে জানতে ও বুঝতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। সুন্দরবন বিষয়ে গবেষক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক বলেন, সামান্য প্রস্তুতি থাকলেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেত। এত বড় ক্ষতি বা বিপর্যয় হতো না। মেডিক্যাল টিম ॥ পেট্রল ও ডিজেলের তুলনায় ফার্নেস অয়েলের ঘনত্ব বেশি এবং দূষণকারী পদার্থ বেশি থাকে। পানিতে তেলের দূষণ ছড়ালে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকরা যাতে কোন চর্মরোগে আক্রান্ত না হয় সে লক্ষ্যে তাদের হাতে পরার জন্য দস্তানা সরবরাহ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ বাকির হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, চর্ম রোগ বা ঠা-াজনিত যে কোন রোগ থেকে কর্মরত শ্রমিক ও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সেখানে অতিরিক্ত মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমও সেখানে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, নদীর পানির রং প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন তেল ভাসতে দেখা যাচ্ছে না। এমটি টোটালের মাস্টারসহ চার নাবিককে মংলা থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমটি টোটালের ধাক্কাতেই ডুবে যায় সাউদার্ন স্টার-৭। শ্যালা নদী চালু নৌপথ বন্ধ করে দেয়ায় মংলা বন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতার উল্লেখ করে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এইচ আর ভূঁইয়া জানান, কার্গো জাহাজের অভাবে বন্দরে অবস্থানরত সাতটি পণ্যবাহী জাহাজের মাল খালাস কাজ ব্যাহত হচ্ছে। মংলাবন্দরের স্বাভাবিক কাজ সচল রাখতে দ্রুত শ্যালা নৌপথের বিকল্প পথ চালুর দাবি করেছেন মংলা পোর্ট পৌরসভার মেয়র জুলফিকার আলী ও মংলাবন্দর ব্যবহারকারীরা।
×